ভুলে যাওয়া কথা মনে করে বলতে বলতে দু’একটা ফিরেও আসে অবিকল। আমি বালকবয়সের মনোযোগ শৈশবে দেখা পথ ও পরিক্রমার স্মৃতি নির্বিকারভাবে হারিয়েছি। তবু মনে হয় ওই তো পেছনে চল্লিশ কি পঞ্চাশ বছর আমার পিঠে লেগে আছে। একটু মেলে ধরে যেসব বলতে চাই, সে কথকও আজ বড়ো ক্লান্ত। স্মৃতির সমস্ত সমর্থনই যেন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে আমি ছড়িয়ে বসেছি যখন কাগজ বলপেন বাগিয়ে। ফেরার পথ আমাকে মাড়িয়ে আমার থেকে লুকিয়েছে।

সোনামুখী গিয়েছিলাম। মাঝে প্রায় চার বছর গলে গেছে বিফল সূচনার চেষ্টায় সেখানে ঢুকে আছে লম্বা করোনা রেটিনা নষ্ট হয়ে হাসপাতাল আর বিছানায় আরোগ্যের দিকে চেয়ে থাকা কর্মহীন সময়। আজ সময়টুকুর সর্বাঙ্গ জুড়েই আমি যেন আড়ম্বর খুঁজেছি, স্মৃতির উদযাপন চেয়েছি পুরনো স্যাঙাতদের সঙ্গে, ব্যস্ততা ছাড়াই জানালায় বা ছাদে কোথাও খন্ডহার খোঁজা বা ফুঁড়ে ওঠা আটতলা কি দশতলার দিকে আমার চোখ। সঙ্গে নিজের গৌরবহীন আস্ত জীবনকে মিলিয়ে দেখা। পথ মাঠঘাট আমূল পাল্টে গেছে এমনকি দশ কুড়ি বছর আগে দেখা বাসে একসঙ্গে চলা দীর্ঘ দুঘন্টার সহযাত্রীদের দলও আলাদা। সময়ের বদলে। বাসস্ট্যান্ডে মানিকের চা দোকানটাও এখন একটু ভদ্রস্ত চালা থেকে একটা পাকা ঘর পেয়েছে। শিশিরের চা-এর ঠেকে তেমন রকমফের হয়নি শুধু সবার মাথার চুলে এক প্রাক্তন হয়ে যাওয়ার ছাপ। ভুলো রাজু ভাড়দার সন্তোষদার দোকানেও ঘুরে ফিরে আড্ডায় কথা হলো ওদের নিজেদের জীবিকা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা কারোর চাকরির হালহকিকত নিয়ে। বুঝতে পারি কোথাও টান হারিয়েছি তাই পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান ফিরে দেখার একটা অনীহা থেকেই যায় তাই কমসময়েও অনেকের সঙ্গে দেখা করার কাজটা হয়ে উঠলো না।

ও বাড়িতে বইপত্র ডায়েরি মায় ম্যাগাজিন যেগুলোর অনেক কটার মধ্যে নিজের লেখাও গোঁজা আছে সেগুলো অনেক বছর নাড়াচাড়া হয়নি। শেল্ফ-এ বাক্সের খোলে কোথাও হাবিজাবি জিনিসের ধুলো ঝেড়ে ছাদে রোদে দিলাম। কিছুটা ভয়ে আর তলের বইয়ে হাত লাগলাম না, কিছুই না আসলে শরীর উৎসাহ দেয়না। মায়াকোভস্কি, নীরেন চক্রবর্তী, শংকরনাথ চক্রবর্তী পাতা ওল্টালাম। কতদিন কত কত লেখা পড়িনা ওসব পড়তে যে তেমন ইচ্ছেও নেই। আচ্ছা এখন কি আর ফিরে গিয়ে চে গেভারা পড়বো… তবু ওটাও নিলাম, কুন্দেরা, শক্তি, তুর্গেনিভ আরও কতগুলোর সঙ্গে। জম্পেশ একটা ভারী প্যাকেট বইলাম বাসস্ট্যান্ড স্টেশনের ওভারব্রিজ। হাঁফ ধরে যায়। পারি না। তবু ওগুলোর জন্যইতো ক্রুদ্ধ পৃথিবীতে বিস্ময়-ঘেরা ধর্মাধর্ম আর কিছুটা ক্লান্তি নিয়ে টিকে আছি।

এখন আমার কোনো টেবিল নেই। অর্থাৎ খেলার কিছুটা সমান্তরাল জমি। এটা অন্ততঃ কোনো ভাবেই ম্যাস্কুলিন ডিফিকাল্টি বলে দাবি করলে ভুল হবে। নিজেকে আলোচনার জন্য চেয়েছি একটা কাউন্টার যেখানে দিনের কিছুটা সময় ধূপধুনো জ্বালিয়ে দোকান খোলা যায়। আমার না থাকা টেরিটরি অজানা অদেখা মাঠের মতো- খেলতে নামার ডিলেমা থেকেই এসবের উদয়।

অন্যের খাওয়াদাওয়া সেসব পছন্দের তালিকা রান্নার ভাঁজভুজ তারিকা শৌখিন ও হ্রস্ব আহার অভ্যাস এবং নিজের একটা মেহগিনি পালিশ দপ্তরী টেবিলের জন্য এখন আমার মন ও ইচ্ছা ছেয়ে আছে। আমার ব্যক্তিগত সার্বভৌম মানচিত্রে নানা সাবেকি কাজচলা ও অথর্ব আসবাব। বইয়ের তাক। খাবারের টেবিল। টি ভি-র জন্য চারপায়া, এক বৃহৎ আলমারি। এবং জানালায় রোদ টুকু প্রসারিত হওয়ার জন্য বিছানার পাশ দিয়ে কিছুটা উন্মুক্ত লাল মেঝে। যে স্থানে এমন ইচ্ছার এক আসবাবি শখ কিছুতেই গ্রাহ্য নয় যেমন আমার এযাবৎ লেখালেখিও গ্রাহ্য হয়নি। কেন এই দপ্তরী মেহগিনি আবলুস রঙা টেবিল এখনই চেয়ে বসলাম? মৃদু দুবলা গোপন ইচ্ছে উস্কে দিলো ওই মাদাম দে রেনাল- এর লেখার টেবিল। যেখানে দেরাজে চাবি দিয়ে রেখেছেন উনি লুসিয়ান সোরেল লিখিত সব চিঠিপত্র। মাদাম বলছেন ওটি তাঁর লেখালেখির টেবিল এবং বর্ণনায় অনুমানে আহা সে মেহগিনি কাঠের লেখার টেবিল!

এ তো গেলো কাষ্ঠের এবং নিজের শুকনো মৌসুমী শখ। আমার অতি খ্যাত এক বন্ধুর রসনার টুকরো গল্প শুনে দেখে আমি সারা সিজনের জন্য নিজেকে ভিজিয়ে রাখি তবে খেতে উৎসাহী আমি কখনোই নই যেমন তার দিনের আহার ফল ফলাদি ভাপা সন্দেশ দ্বিপ্রহরে সামান্য ভাত মাছ বা মাংস ডাল সবজি এবং সন্ধেয় কোনোদিন রাবড়ি বা পুটিরাম জাতীয় কৌলিন্যে সুস্বাদু সন্দেশ ও রসগোল্লা- না না রসগোল্লার জন্য তার বিশেষ দোকান আছে যেমন ডিমের মাংসের আনারসের রসুনের এবং সেরা দানার কাবলি ছোলারও দোকান নির্দিষ্ট। তিনি রাতের সামান্য আহারে কাবলিদানা ও মুরগির মাংস বিশেষ আনারসে ভেজানো মাস্টার্ড অয়েলে তৈরি করে নেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version