ভেতরে কোনও শব্দ নেই। পূর্ব জন্মের রাস্তা, পর জন্মের ঝুলন সবই থমকে ওই টেবিলে। ঝিমোচ্ছেন বিচারক। বাদীপক্ষ, উকিল, কেরানি গোল করে টেবিলে আড্ডায় মশগুল। ফাঁকা কাঠগড়ায় আমি একা। বুকের পাঁজর ফুরফুরে কাগজের মতো অবলীলায় খুলে ফেলছে দীর্ঘ নির্জন চাঁদনি রাত। যন্ত্রণার আবর্ত এসে টেনে নিচ্ছে শুভদৃষ্টি -ফুলশয্যার মুহূর্তকে। ছত্রে ছত্রে ফিরে ফিরে আসে বেবি ফুড, পাঠভবন, দাতব্য কম্বল। কাঠগড়ায় আমি স্বপ্নমত্ত এক চক্ষুহীন যুবক। উথাল পাথাল সময়ে যখন ফাটছে ঘড়ি, ওদিকে হেলদোল নেই। আসর জমেছে উকিল-বিচারক-কেরানির।

শুন্যে ডুবে একা আমি। কলতলা আর গঙ্গার ঘাট সব যেন একাকার। হঠাৎ পরম আশ্চর্যে এল তিলোত্তমা বাণী। অনেকটা সেই উতলা হাওয়ার ভেলা ভাসানের মতো। সেই বাণী ছোবল বসালো বুকে, বক্ষমূলে। “ছাড়ুন তো। মেঝের ছায়া যখন বিরোধিতা করে, তখন শুধুশুধু তোরঙ্গভর্তি মোহরের স্বপ্ন দেখেন কেন? দাওয়ায় বসে বসে তো হাত পা লম্বা করে ফেলেছেন। ফর্দ উড়ে গিয়েছে, ঠিক আছে, রথের মেলা থেকে কি আর কিছুই কেনার নেই?” শুনি স্বপ্নসম হে দেবী তোমার বাণী। হে পর্বত, হে অরণ্য, হে পুণ্যতোয়া নদী। তোমরা ত্রিভূবন হয়ে ঘিরে রাখো আমাকে। আমি কাঠগড়া থেকে নামছি। ক্লেশহীন হয়ে, আজানু পাঁক থেকে উঠে, শুন্যকলসের আত্মমগ্নতা ছেড়ে, মর্মরে ফুটে ওঠা ফুলের বাণীতে আমি সাবলীল হয়ে নামছি কাঠগড়া থেকে। কিন্তু তখনও যে বিচারক রায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। দোনামনা।

আবার সেই বাণী, “কাঁচের এধারে আসুন। কাঁচের এধারে কেউ নেই। ঝিমন্ত গৃহস্থালীর নিভন্ত উনুন থেকে বাঁচুন। একেবারে একা হয়ে নিজেকে চিনুন। জানুন। বুঝুন, ঘুমন্ত আর জীবন্তের পার্থক্য। কাঁচের এ পাশে আসুন। নিদ্রাহীন লাল আপনার জন্য স্তব্ধ অপেক্ষায় আছে।”একটা একটা করে ভাঙছে সেতু। তেলহীন চামড়া ফেটে বেরোচ্ছে রক্ত, পথবাসী কুকুরেরা বন্ধ করে দিয়েছে খেলা, সুবাতাস ভরা নৌকোগুলোও ডুবুডুবু, জগৎ সংসার চিন্তাকুল। মধ্য জীবন। মধ্য যৌবন। দুঃখির সংসার শুনেছে গোপন গর্জন। হিম হওয়ায় উড়ে গিয়েছে শীতের ভয়। দিনের আলোয় অপেক্ষমান ন্যাংটো ঝুল বারান্দা। আওয়াজহীন ঘুঙুরের বোলে উইঢিপির গান। মরা মরা থেকে বদলে যাওয়া রাম রাম সানাই। তার মাঝেই আসে সেই স্বপ্নবাণী, “অন্তত দেখুক ওরা, কার ভরসায় আমি লড়ি।”

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version