(প্রথম পর্ব)

ইন্দ্রনীল বসু। ছবি: প্রতিবেদক

দিনটা দ্বাদশী কি ত্রয়োদশী হবে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। আশ্বিনের পড়ন্ত বেলায় গাড়ি নামিয়ে দিলো সারাহানে। গিন্নির আবদার মানতে গিয়ে পুজোর সময়টা কলকাতায় থাকতে হয়েছিলো। ভেবেছিলাম ভিড়টা কম হবে। ভালই হবে। হলো ও তাই। সারাহান পৌঁছে দেখি প্রায় সব ফাঁকা। আর একটা ভাবনা কাজ করছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমায় হিমালয় দর্শন।

হোটেলের ছাদের ওপর ঘর বুক করাই ছিল। মালপত্র নিয়ে উঠে গেলাম। ঘরের তিন দিক দেওয়াল। আর একদিকে বিরাট কাঁচের জানালা। পর্দা সরালেই দিগন্তবিস্তৃত পর্বতের হাতছানি। সিমলায় একদিন থেকে রামপুর হয়ে সোজা সারহান। ধকল একটু গেছে বৈকি। তবে রাতে একটা ঘুম দিলেই সব ধকল চলে যায় পাহাড়ে। তাই আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়লাম ভিমাকালি মন্দির দর্শনে। কাঠের এত সুন্দর কারুকার্য আর কোথাও দেখিনি। অন্তত কোনো মন্দিরে তো নয়ই। শ্রীখন্ড পর্বত চূড়ায় পায়ের কাছে দেবী তীর্থ সারাহান। বিরাট মন্দির কমপ্লেক্স। ওই একই চত্বরে রঘুনাথ মন্দির। একটু দূরে রাজপ্রাসাদ। বহুদিন আগে বুসাহার রাজারা কমরু থেকে তাদের রাজধানী সারহানেই সরিয়ে আনেন। চারিদিক সবুজে ঢাকা। ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজছে। সন্ধ্যার আলো সবে জ্বলে উঠছে। মন্দিরটা ঘুরে দেখলাম । ভিতরে গিয়ে আমার স্ত্রী পিয়ালী পূজা দিলো । আমার পুত্র সাগ্নিক তখন ক্যামেরার শাটার টেপায় ব্যস্ত হয় পড়েছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে দেখি মেলা বসেছে। এখানে দুর্গাপূজা আর দশেরায় বড় উৎসব হয়। উৎসবকে কেন্দ্র করেই পাহাড়ে মেলা বসে। বিভিন্ন খেলনার দোকান, পশমের টুপি, শাল, সোয়েটার, তেলেভাজা, জিলিপি কি নেই! সন্ধ্যা নামছে বলে ভিড়টা পাতলা হয়ে গেছে। দোকানিরাও তল্পিতল্পা গুটিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হব হব করছে। আমরাও আর দেরি না করে সমোসা আর চা খেয়ে রওনা দিলাম আস্তানায়। সন্ধ্যাটাও বড় সুন্দর কাটলো ছাদে বসে। পরদিন আর একটা লম্বা সফর। তাই ডিনার করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পরদিন ভোরে উঠে দেখি নীল ঝকঝকে আকাশ। পাহাড়ের একদিক থেকে সূর্য উঠছে। বেশ কয়েকটা আপেল গাছ দেখতে পেলাম। বেড টি দিতে এসে হোটেলের একটা ছেলে বলে গেলো, ” সেব ( আপেল ) দেখনা হ্যায় তো সংলা যাইয়ে।” শুনেছি সংলায় অনেক আপেল বাগান আছে। সস্তাও। দু এক পেটি নিয়ে যাবারও ইচ্ছা আছে কলকাতায়। তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। সাংলা বহুদূর।

ব্রেকফাস্টের জন্য তাড়া লাগাতে হলো। অবশেষে আলুর পরোটা আর সবজি মিললো। পরম তৃপ্তি ভরে পেটপুজো সেরে বেরিয়ে পরলাম। সান্ত্রো ছুটে চললো পাহাড়ের বুক চিরে। ড্রাইভার অশোক ত্রিপাঠি রফি সাহেবের খুব ভক্ত। কাল মহম্মদ রফির গান শুনিয়েছে। আজ মহেন্দ্র কাপুরের গান চলছে, ” তুম আগার সাথ দেনে কা ওয়াদা করো/ ম্যায় ইউহি মস্ত নাগমে লুটাতা রাহু । ” পাহাড়ে যেতে যেতে পাহাড়ি সিকোয়েন্স এর গান মন ভরিয়ে দেয়। পুরনো দিনের গানের একটা মাদকতা আছে। নতুন গানে প্রাণ খুঁজে পাই না বড় একটা। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। হালকা গানের সঙ্গে গাড়ির জানালা দিয়ে প্রকৃতির অপরূপ শোভা। কত অচেনা অজানা গাছ, পাখির ডাক, ছোটো ছোটো পাহাড়ি জনপদ পেরিয়ে চলেছি। কত মানুষকে হিমালয় তার রূপে ভুলিয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে তেনজিং নোরগে, কত মানুষ এই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যর টানে বারে বারে বেরিয়ে পড়েছেন – তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই বারে বার। কিছুক্ষণ পরে কিন্নর দ্বার এলো। সেখানে ড্রাইভার সাহেব নামিয়ে দিলেন আমাদের । এর পর থেকে কিন্নর কৈলাশ শুরু। কিন্নর কিন্নারির গল্প শুনেছি আগে। তাদের রূপ অপরূপ। আজ তাদেরই দ্বারে দাঁড়িয়ে আছি। তাদের দেশে যাবার জন্য। খাদ পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে রাস্তা চলে গেছে। শুনেছি রাস্তায় মাঝে মাঝে ধস নামে। উঠে পড়লাম গাড়িতে। বিকেলের দিকে সাংলা এসে পৌঁছালাম।

আজ প্রায় ১০৫ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ অতিক্রম করেছি। বসপা নদীর ধারে রং বাহারি প্রকৃতির কোলে ২৬৮০ মিটার উচ্চতায় ছোটো পাহাড়ি গ্রাম ও উপত্যকা সাংলা। তুষার শৃঙ্গ দিয়ে ঘেরা প্রকৃতি। বুকিং অনুযায়ী থাকার জায়গা মিলে গেলো । গরম গরম চা আর একটা সিগারেট টেনে সারা সন্ধ্যা বসে রইলাম বারান্দায়। একটু পরেই পাকোড়া আর দ্বিতীয়বারের চা চলে এলো। কলকল করে বসপা নদী বয়ে চলেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। বিশ্ব চরাচর লুপ্ত হয়ে যায় যেন সেখানে। কত যুগ যুগান্ত ধরে এই পর্বত শ্রেণী একই ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কত ইতিহাসের সাক্ষী এই আকাশ, নদী, পাহাড় চূড়া। বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। জ্যাকেটের ওপর একটা চাদর জড়িয়ে বসেছিলাম। ন’টার সময় ডিনার এলো। পেটে তখন ছুঁচো দৌড়াচ্ছে । ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুম চলে এলো।

                                                                         (চলবে)
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version