জগন্নাথ সামন্ত | ছবি- গৌর শর্মা
অজয় নদের তীরবর্তী এলাকায় কেন্দুবিল্ব গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সাধক কবি, গীতগোবিন্দ কাব্য প্রণেতা জয়দেব। কেন্দুবিল্ব অপভ্রংশ হয়ে কেঁদুলি বা কেন্দুলী। অজয় নদ এইখানে বর্ধমান- বীরভূম জেলার সীমা নির্ধারণকারী। ভক্তকবির স্মৃতিরক্ষার্থে এইখানে নির্মিত হয়েছে রাধাবিনোদ মন্দির। পৌষ সংক্রান্তিতে এইখানে যে মেলা বসে সেটি কেন্দুলী মেলা বা জয়দেব মেলা নামে খ্যাতি লাভ করে। জয়দেব কেন্দুলী মেলা বহু চর্চিত ও প্রচারিত।

বর্তমান প্রবন্ধ এর আলোচ্য বিষয়-বর্ধমান জেলার পশ্চিম প্রান্তে দামোদরের তীরে বসা আরেকটি কেন্দুলী মেলা।

হিরাপুর-বার্নপুরের দক্ষিণে বর্ধমান- বাঁকুড়া জেলার সীমা নির্দেশ করে বয়ে চলেছে দামোদর নদ। দামোদর তীরবর্তী কালাঝরিয়া গ্রামের প্রয়াত গোবিন্দপ্রসাদ
লায়েকের পূর্বপুরুষ জনৈক জমিদারের গৃহে আগমন ঘটে বৈষ্ণব সাধক প্যায়ারীচাঁদ বাউলের। তিনি ওইদিন দুপুরে জমিদার বাড়িতে কুমড়োর তরকারি ও ভাত খাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু ঘরে তো কুমড়ো নাই। গৃহকর্তাকে চিন্তা করতে দেখে প্যায়রি বাবা বলে -আরে খামার বাড়িতে খুঁজে দেখ দুই একটা কুমড়ো পেয়ে যাবি। খামার বাড়িতে গিয়ে তিনি দেখলেন কুমড়ো গাছে ফলে আছে অনেক কুমড়ো। তিনি বুঝতে পারেন যে এটা প্যায়ারি বাবার অলৌকিক ক্রিয়া ছাড়া কিছু নয়। সেই শুরু।
জমিদার পরিবারের অনুরোধে প্যায়ারি বাবা থেকে গেলেন। তার জন্য খামার বাড়িতে তৈরী হল কুটুরি । প্যায়ারি বাবা সারাদিন দামোদর তীরে এক সুউচ্চ বৃক্ষের তলায় বসে সাধন ভজন করেন। জমিদার বাড়ি হতে নিয়মিত খাবার আসে। সন্ধ্যায় গ্রামে ফিরে হরিনাম সংকীর্তনে মেতে ওঠেন। তার আরাধ্য দেবতা যে গৌরসুন্দর।

দিনে দিনে বাড়তে থাকে প্যায়ারি বাবার ভক্তের সংখ্যা। বাঁকুড়া মালভূম জেলা থেকে আসতে শুরু করে ভক্ত মানুষজন। প্যায়ারি বাবার মানবপ্রেম ও অলৌকিক কাহিনী শুনে তৎকালীন পঞ্চকোট / কাশিপুরের মহারাজা হরিশ্চন্দ্র শেখর সিংহদেও প্যায়ারি বাবার নামে কিছু সম্পত্তি দান করেন। দেবোত্তর সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব জমিদার পরিবারের ওপর ন্যস্ত হয়। প্যায়ারি বাবার ইচ্ছা অনুসারে জমিদার পরিবারের লোকেরা মকর সংক্রান্তিতে দামোদর এর উত্তর পারে মেলার আয়োজন করেন।
প্যায়ারি বাবা এই মেলার নাম দিলেন কেন্দুলী মেলা। জমিদারি প্রথা বিলোপ হয়েছে প্যায়ারি বাবা নেই তাও মেলা বন্ধ হয়নি। বর্তমানে দেখাশোনা করে কালাঝরিয়া গ্রামীণ সংস্কৃতি বিকাশ মঞ্চ। লোক সংস্কৃতি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে। অজয় নদীর তীরে বীরভূম জেলায় কেদুলি বা জয়দেব মেলা আর বর্ধমান জেলায় দামোদর তীরে কালাঝরিয়া কেন্দুলী মেলা। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তি সন্ধ্যায় কালাঝরিয়া গ্রাম থেকে মূল মন্দির হতে ঠাকুর কে দামোদর তীরের প্যায়ারি বাবা মন্দিরে আনা হয়। খোল করতাল ও কীর্তন সহযোগে। ৩রা মাঘ সন্ধ্যায় মূল মন্দিরে ঠাকুরের প্রত্যাগমন হয়। এখন ১লা মাঘ -৪ মাঘ পর্যন্ত মেলা চলে। ২রা মাঘ দুপুরে ঠাকুরকে খিচুড়ি ভোগ নিবেদন করার পর শুরু হয় নারায়ণ সেবা। এই গরম খিচুড়ি ভোগের কিছুটা একটা পাত্রে আবদ্ধ করে গভীর রাতে মাটির তলায় পুঁতে রাখা হয় ও পরের বছর ২রা মাঘ মাটির তলা থেকে তুলে সেই ভোগ মূল ভোগের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। কিংবদন্তী হলো এক বছর পরও সেই ভোগ গরম থাকে। এটা ভক্তজনের বিশ্বাস।

লায়েক পরিবারের প্রবীন ব্যক্তি অস্বীনী লায়েক ও মেলা কমিটির সদস্যরা জানান। প্যায়ারি বাবা ভক্ত দের কাছে ঠাকুর নামে পরিচিত। আরও আশ্চর্য হলো তার কোনো বিগ্রহ নেই। তার পূজা হয় প্রতীকে। প্রতীক বলতে সিংহাসনে স্থাপিত থাকে একটা সাবেকি ছড়ি, একটা চিমটা, একজোড়া খরম, কাঁথা ও সযত্নে বাঁধা ছয়টি হাতে লেখা পুরাতন পুঁথি। এগুলো রচয়িতা প্যায়ারি চাঁদ বাউল। তাতে কি লেখা আছে আজও তা কেউ জানেনা কারণ পুঁথিগুলি কেউ পাঠ করেনি।

প্যায়ারি বাবার পরিচয় জানা যায়না, এমনকি দামোদরের তীরে তার সাধন স্থলের পাশেই রয়েছে সমাধি মন্দির। তার গাত্রেও কোনো সাল তারিখ নেই। কেন্দুলীর সাথে তার কি কোনো যোগসূত্র ছিল? এর উত্তর কারোর জানা নেই। রহস্য ও কিংবদন্তীতে ভরা প্যায়ারি বাবার জীবন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version