পঞ্চম মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহিউদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব সিংহাসনে আহোরণ করে ৪৯ বছর মুঘল সাম্রাজ্য শাসন করেন। তিনি সম্রাট আওরঙ্গজেব নামেই সর্বাধিক পরিচিত। মুসলিম জাহানের মহান এই সম্রাটকে বাহাদুর আলমগীর, বাদশা গাজী, প্রথম আলমগীর নামেও সম্বোধন করা হত। তবে সম্রাট আওরঙ্গজেবের সম্পূর্ণ রাজকীয় নাম ছিল আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম হযরত আবুল মুজাফফর মুই-উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর প্রথম, বাদশা গাজি, শাহানশাহ-ই-সালতানাত-আল-হিন্দিয়া ওয়া আল মুগলিয়া।

সম্রাট হওয়া সত্বেও আওরঙ্গজেব সাধারণ মানুষের মত জীবন যাপন করতেন। শাসক হিসেবে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের পদাংক অনুসরণ করতেন। যার একটি নমুনা পাওয়া যায় দরবারী ইতিহাস লেখা প্রকল্প বন্ধ করণের মধ্য দিয়ে। সম্রাট আরঙ্গজেব এর রাজত্বকালের দরবারী ইতিহাস হচ্ছে আলমগীর নামা। তিনি প্রথমে মিরজযা মুহাম্মদ কাজিমকে তাঁর রাজত্বকালের ইতিহাস লেখার আদেশ দেন এবং তিনি সম্রাটের রাজত্বকালে প্রথম দশ বছরের ইতিহাস লেখেন। যার নাম ‘আলমগীর নামা’। ১১০৭ পৃষ্ঠা সম্বলিত বিশাল আকারের একটি বই। যদিও সম্রাট আওরঙ্গজেব মিরজযা মুহাম্মদ কাজিমকে ইতিহাস লিখতে নিষেধ করেন এবং এক সময়ে ইতিহাস লেখা বন্ধ করে দেন।

যদুনাথ সরকারের মতে, ‘সম্রাট আরঙ্গজেব আর্থিক দুরবস্থার কারণে ইতিহাস লেখা বন্ধ করা হয়, ইহা সত্য বলে মনে হয় না। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বীয় কৃতিত্ব ফলাও করে প্রচার করার চেয়ে, ধর্মীয় অনুশাসন পুরোপুরি মেনে চলাই শ্রেয়।’ এ থেকে বোঝা যায় দরবারী ইতিহাস লেখাকে তিনি রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপচয় মনে করতেন। সেই কারণেই তিনি ইতিহাস লেখার প্রকল্প বন্ধ করে দেন। সম্রাট আরঙ্গজেব মুলত পূর্ণাঙ্গভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কারণে তাঁর ব্যক্তি জীবনযাত্রা ছিল অন্যান্য সম্রাটদের চেয়ে সম্পূর্ণই আলাদা। তিনি কুরআন হেফজ হবার পাশাপাশি একজন বিজ্ঞ আলেমও ছিলেন। একই সাথে তিনি আরবি-ফারসি, তুর্কীয়, হিন্দি-সহ অন্যান্য আরও ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি ইসলামী শরিয়তের পরিপূর্ণ প্রবর্তনের লক্ষ্যে সাম্রাজ্যের মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে বড় ধরণের পরিবর্তন আনেন। এর মধ্যে জিজিয়া কর প্রথা চালু করেন। আর মুসলমানদের জন্য যাকাত ও ওশর অর্থাৎ জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের দশ ভাগের এক ভাগ দেওয়া বাধ্যতা মূলক করেন। তবে জিজিয়া কর প্রথা চালু করায় হিন্দুরা মনঃক্ষুন্ন হন। কারণ পূর্ববর্তী সম্রাটদের সময় দীর্ঘকাল ধরে জিজিয়া কর রহিত ছিল।

তিনি ১০৭৯ হিজরি সালে দর্শন প্রথা অর্থাৎ সকাল বেলা বাদশার পবিত্র মুক্তি লাভের আশায় আগমন করা এবং যতক্ষণ না ঘটে ততক্ষণ আহার গ্রহণ না করা প্রথা বন্ধ করে দেন। ১০৮৮হিজরিতে মুঘল সম্রাটদের দরবারে নওরোজ নামে একটি প্রথা চালু ছিল। এই প্রথার মাধ্যমে দরবারে অহঙ্কার ও বিলাসিতা প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা হত। মুঘল কর্মচারীদের মধ্যে মদ্যপানের প্রচলন ও আফিম খাওয়ার প্রথা বন্ধ করেন। এক কথায় ইসলামবিরোধী নওরোজ প্রথা তিনি পুরোপুরি বন্ধ করে দেন।

এছাড়া সম্রাট আওরঙ্গজেব নিজের হাতে লেখা কুরআন শরিফ বিক্রী এবং টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাষ্ট্র ও জাতির রাজকোষ থেকে নিজের জন্য অর্থ গ্রহণ করাকে তিনি বৈধ্য মনে করতেন না। টুপি ও কোরআন থেকে শেষ জীবনে মাত্র ‘আটশ পাঁচ টাকা’ সঞ্চয় করেন। আওরঙ্গজেবের স্বহস্তে লিখিত একটি উইল মৃত্যুর পর তাঁর বালিশের নিচে পাওয়া যায়। (ক) আমার টুপি সেলাই এর ‘চার টাকা দু’আনা’ গচ্ছিত আছে, মহলদার আইয়া বেগের কাছে। এটা দিয়ে ক্রয় করো অসহায় এই জীবের কাফনের কাপড়। (খ) কুরআন শরিফ (লিখিত কপির) বিক্রীর তিনশো পাঁচ টাকা রাখা আছে আমার থলিতে। আমার মৃত্যুর দিন ওটা বিতরণ করে দিও ফকিরদের মধ্যে। যেহেতু কুরআনের মাধ্যমে উপার্জিত টাকা শিয়ারা সুনজরে দেখে না, ওটা যেন ব্যয় করোনা আমার কাফনের কাপড় কেনা কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজনে।

সম্রাট আওরঙ্গজেবর খোদাভীরুতার জন্য সাধারণ মানুষের কাছে ‘জিন্দা পির’ হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেন। তাঁর অনবদ্য রচনা “ফতোয়ায়ে আলমগীরী”। এটিকে শরিয়াহ আইন এবং ইসলামি অর্থনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শাসক হিসেবে প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রায় সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেন। তাঁর আগে এবং তাঁর শাষন আমলের প্রথম সময়ও হিন্দুরা ব্যাপক দুধর্ষ ছিল। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকাল এর সপ্তমবর্ষ পর্যন্ত হিন্দুরা এত প্রবল ছিল যে, মসজিদগুলিকে ভেঙে নিজেদের বসবাসের কাজে ব্যবহার করত এবং মুসলিম সম্ভ্রান্ত মহিলাদের বলপূর্বক ঘরে আটকে রেখে বিয়ে করত। এছাড়া আরঙ্গজেবের দ্বাদশবর্ষ রাজত্বকাল পর্যন্ত হিন্দুদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক বিদ্যা শিক্ষা দিত। আওরঙ্গজেব যখনই শিক্ষা বন্ধ করতে প্রস্তুত হলেন তখন হিন্দুদের বিদ্রোহ শুরু হয়।

সম্রাট আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের সীমানা বহুদূর বিস্তার করে দক্ষিণাঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর সময় সাম্রাজ্যের বাৎসরিক করের পরিমাণ ছিল ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। যা তার সমসাময়িক চতুর্দশ লুইয়ের আমলে ফ্রান্সের বাৎসরিক করের চেয়ে ১০ গুণ বেশি ছিল। তাঁর সময় ভারত চীনকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। যার পরিমাণ ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলার। যা ১৭০০ সালে সমগ্র পৃথিবীর জিডিপি’র এক চতুর্থাংশ। ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় তার শাসনামলে সমপরিমাণ রাজস্ব কোনো সম্রাটের সময় হয়নি। এমনকি তিনি ৪ কোটি পাউন্ড অর্থাৎ ৬০ কোটি টাকা মুকুফ করে দেন। কিছু ঐতিহাসিক আওরঙ্গজেবকে শাসক হিসেবে “বিতর্কিত এবং সমালোচিত” করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর আমলে অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল বলে প্রচার চালানো হয়। তবে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, তাঁর হিন্দু মন্দির ধ্বংসের বিষয়টি অতিরঞ্জিত।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version