তিনি ছন্নছাড়া, পাগলাটে। তিনিই আবার আজন্ম বিপ্লবী, সে বয়ান দিয়েছে তাঁর ক্যামেরা। তাঁর ছবি মানে তাঁর নিজের বিশ্বাস আর আদর্শ। যা তিনি নিজের ছবিতে বলতেন সেটা তাঁর বিরক্তি, ঘেন্না আর ভালবাসা। জীবনকে এতটুকু ছাড় দেননি, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সেই স্পর্ধা ছিল অটুট। কাওসার আহমেদ চৌধুরীর অপ্রকাশিত লেখা থেকে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তান সদ্য বাংলাদেশ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটক বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন। তাঁরা একই বিমানে ঢাকার পুরোনো বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঋত্বিক ঘটক ও সত্যজিৎ রায়কে। বিশেষ বিমানে পাশাপাশি বসে দুই কিংবদন্তি চিত্রপরিচালক। আকাশ বেয়ে এগচ্ছে বিমান নীচে পদ্মা, দু’ধারে বাংলার আদিগন্ত মাঠ, গ্রাম। এই তো আমার বাংলা! আমার জন্মস্থান! আর আজ তার থেকেই এত দূরে আমরা! জানলা দিয়ে নীচে তাকিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেন ঋত্বিক। এ যে তাঁর বাংলাদেশ। তাঁর বাংলা। এতদিন পর, এইভাবে সেই পদ্মাকে দেখে কি আর সামলানো যায়?

অভ্যার্থনা পর্ব মিটে যাওয়ার পর ঋত্বিক জানান, তোমরা ওঁকে (সত্যজিৎ রায়) নিয়ে যাও, আমি এসেছি আমার জন্মভূমি দেখতে। বাংলাদেশে ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর আলাপ হয়েছিল ঢাকার নিউ ইস্কাটন এলাকার একটি ক্যাম্পে। সাধারণত ওই ক্যাম্পগুলি হত পরিত্যক্ত কোনো বাড়িতে। ওই ক্যাম্পটিও ছিল পরিত্যক্ত একটি একতলা বাংলো বাড়ি। প্রসঙ্গত, ঢাকা শহরেরই জিন্দাবাহার লেনে ঋত্বিক ঘটকের জন্ম। বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ডাকসাইটে আমলা। তাঁরা নাটোরের মহারানির বংশধর। দেশ বিভাগের পর প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তখন থেকেই তাঁর এক দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের শুরু।

ঢাকার নিউ ইস্কাটন এলাকার ওই ক্যাম্পে ঋত্বিক এক মাসের বেশি ছিলেন। ক্যাম্পের বেডরুমে কাওসার আর ঋত্বিক পাশাপাশি বিছানায় শুতেন।এক রাতে ঋত্বিক কাওসারকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কী করিস? কাওসার আমতা-আমতা করে বললেন, গান লিখি। শুনে ঋত্বিক জোরে হেসে উঠে বললেন, হারামজাদা তুই গান লিখিস। গান যা লেখার সে তো লিখে চলে গেছেন ওই দেড়ে ঠাকুর, নজরুল, লালন, মির্জা গালিব—এঁরা। তলায় যেটুকুন পড়েছিল, সেটা কুড়িয়ে নিয়ে গেছে প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গুপ্ত—এঁরা। তুই আর গান লিখে কী করবি? তা ছাড়া গান কোনো কমপ্লিট আর্ট নয়। ফিল্মটা হচ্ছে বিজ্ঞান ও শিল্পের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা কমপ্লিট আর্ট। কাওসার মুখ কাঁচুমাচু করে জানিয়েছিলেন, আসলে দাদা, ফিল্মটাই হচ্ছে আমার জীবনের প্রথম আকর্ষণ। ভয়ে আপনাকে বলতে পারিনি। ঋত্বিক বললেন, এ নিয়ে পড়াশোনা কিছু করেছিস? কাওসার বললেন, খুব সামান্য কিছু পড়েছি। ভালো বইটই এখানে তেমন পাওয়া যায় না।

এ ধরণের আলাপচারিতা চলাকালীন কাওসার ঋত্বিককে জিজ্ঞেস করে বসেন, দাদা, বলুন তো ভারতবর্ষে শ্রেষ্ঠতম চিত্রনির্মাতা কে? ঋত্বিক উত্তরে জানান, সত্যজিৎ রায়। ও হচ্ছে চুলের আগা থেকে নখের ডগা পর্যন্ত কমপ্লিট আর্টিস্ট। তবে একটু দরজি টাইপ আরকি। খুব মেপে মেপে কাটে। বাংলাদেশে ওই ক্যাম্পে থাকাকালীন ঋত্বিক মাঝেমধ্যে কাওসারকে বলতেন, আমার জন্মস্থান জিন্দাবাহার লেনে নিয়ে চল। কাওসারের হেফাজতে তখন বেশ কয়েকটি গাড়ি ছিল। তারই একটি নিয়ে এসে যখনই ওঁ বললতেন, চলুন দাদা জিন্দাবাহার লেনে চলুন। ঋত্বিক তখনই কোমরে তোয়ালে প্যাঁচানো অবস্থায় বাইরে এসে গাড়িতে একটা লাথি মেরে বলতেন, এটা কে আনতে বলেছে তোকে, ঘোড়ার গাড়ি আন! কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি কাওসার যোগার করতে পারেনি তাই কোনো দিনই আর তাঁকে ঘোড়ার গাড়িতে জিন্দাবাহার লেনে নিয়ে যাওয়া হয়নি। এদিকে প্রায় এক মাস হতে যায়। ঋত্বিকের কলকাতা ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে আসে। একদিন কাওসার তাঁর নিজের ফক্সওয়াগনে ঋত্বিককে নিয়ে তাঁর তারুণ্যের রাজশাহী হয়ে ফারাক্কা বাঁধ পার হয়ে সাড়ে চারশো মাইল ঘুরে কলকাতায় পৌছায়।

রাশিফল লিখলেও কাওসার আহমেদ চৌধুরী একজন গীতিকবি, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী। তাঁর লেখা আইয়ুব বাচ্চুর কণ্ঠের বিখ্যাত গান ‘এই রুপালি গিটার ফেলে, একদিন চলে যাবো দূরে বহুদূরে। সেদিন চোখের অশ্রু তুমি রেখ গোপন করে!’ নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’-এর প্রচ্ছদ করেছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তিনি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলেন। হয়তো সেই কারণেই ঋত্বিক ঘটক তাঁর ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে একজন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে কাওসার আহমেদকে অভিনয় করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু নানা কারণে সে কাজ কাওসারের করা হয়ে ওঠেনি।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version