নোহকালিকাই ভারতের বৃহত্তর জলপ্রপাতগুলির মধ্যে একটি। এটির অবস্থান মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে। উচ্চতা ১১৭০ ফুট। এটি ধাপে ধাপে না পড়ে একবারে সোজাসুজি পাহাড় থেকে নীচে পড়ছে। নোহকালিকাই জলধারার নীচের জলাশয়ের রং পান্নার মতো সবুজ ও স্বচ্ছ। দিনের রোদে সেই জলে খেলা করে রামধনুর সাতটি রং। শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরবর্তী চেরাপুঞ্জি যাওয়ার পথে খাসি পাহাড়ের নয়নভিরাম শোভা  মন ভরিয়ে দেয়।পূর্ব খাসি পাহাড় জেলায় অবস্থিত এই অত্যাশ্চর্য স্থানের মতোই বিষাদময় কাহিনি জড়িয়ে আছে নোহকালিকাই জলপ্রপাতে। 

খাসিদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজে বিয়ের পর স্বামী ঘরকন্না করতে চলে আসেন স্ত্রীর বাড়ি৷ খাসি পরিবারে সাধারণত রোজগারের দিকটি দেখেন স্ত্রী আর বাড়ির কাজ দেখভাল করেন স্বামী৷ সমাজের এই নিয়ম মেনেই জীবন চলছিল রংযাইরতেহ গ্রামের লিকাইয়ের৷ কিন্তু বেশিদিন সেই জীবনও স্থায়ী হল না। মাত্র ১৯ বছর বয়সে স্বামীকে হারালেন লিকাই৷ এক মেয়ে সন্তানকে নিয়ে শুরু হল লিকাইয়ের বৈধব্য যাপন৷ জঙ্গলে কাঠ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেই সংসার চালাতে থাকলেন লিকাই৷ ইতিমধ্যেই এক যুবক  লিকাইয়ের প্রেমে পড়লেন৷ কিন্তু মেয়ে রয়েছে বলে দ্বিতীয়বার আর ঘর বাঁধতে রাজি হলেন না লিকাই৷ কিন্তু ওই যুবক অসীম ধৈর্য ধরে ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন৷  লিকাইয়ের মনে আবার সংসার গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনতে লাগলেন৷ একদিন  রাজি হয়ে যান লিকাই৷ লিকাইকে বিয়ে করে সামাজিক রীতি অনুযায়ী লিকাইয়ের বাড়িতে এসে সংসার করতে শুরু করলেন যুবক৷

দিনে লিকাই কাজ করেন আর মেয়েকে সামলান ওই যুবক৷ রাতে বাড়ি ফিরে মেয়েকে নিয়ে সময় কাটায় লিকাই৷ স্ত্রীকে একা চেয়েও পাশে পাননা যুবক৷ এর জন্য লিকাইয়ের মেয়েকে দায়ী করতেন তিনি৷ ধীরে ধীরে মেয়ের উপর আক্রোশ তৈরি হয়৷ লিকাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেই মেয়েকে বেধড়ক মারধর করতে শুরু করতেন৷ প্রথমদিকে টের না পেলেও একদিন কাজ সেরে বাড়ি ফিরে মেয়েকে দেখতে পেলেন না।অনেক খোঁজখবর করলেন, শেষে সবামীর রান্না করা মাংস খেয়ে পান সাজতে বসে লিকাইয়ের চক্ষু চড়কগাছ৷ দেখলেন পানের বাটার মধ্যে মেয়ের কাটা আঙুল৷

ইতিমধ্যেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন দ্বিতীয় স্বামী৷ পাহাড়ের কোল থেকে তাকে টেনে বের করে আনেন গ্রামবাসীরা৷ নিজের মুখেই তিনি স্বীকার করেন আক্রোশের বশেই মেয়েকে খুন করেছেন। মেয়ের মাংসই তিনি রান্না করে খাইয়েছেন লিকাইকে। এত কিছুর মধ্যে ওই আঙুলটি ফেলতে ভুলে যান৷ আর সেটা থেকেই  লিকাইয়ের মনে সন্দেহ জাগে৷ মা হয়ে মেয়েকে খেয়েছে লিকাই। এক রাক্ষুসীর অভিশপ্ত জীবন নিয়ে কীভাবে বাঁচবে সে। লিকাই তীরের বেগে পাকদণ্ডি পথে দৌড়ে চলেন ঝর্ণার দিকে। পিছন পিছন গ্রামবাসীরা ছুটে যান। ওই তো তার মেয়ে ঝর্ণার মাঝে রামধনু হয়ে ডাকছে তাকে। লিকাইও ঝর্ণা হয়ে রামধনু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে থাকবে। আর কেউ তাদের আলাদা করতে পারবে না।পাগলের মত বিড়বিড় করে বকতে বকতে ঝর্ণার ধারে সবচেয়ে বড় পাথরটার ওপর উঠে দাঁড়ায়। খাসি পাহাড়ে ডুবন্ত সূর্য তখন দিনের শেষ রামধনু আঁকছিল ঝর্ণার বুকে। লিকাই রামধনুর বুকে দেখে মেয়ের মুখ।দু’হাত বাড়িয়েই ঝাঁপ দেয় লিকাই ১১১৫ ফুট নীচে। সেই থেকে ঝর্ণা হয়ে গেছে লিকাই। তারপর থেকে লিকাইয়ের নাম অনুযায়ী ওই ঝরনার নাম হয়েছে নোহকালিকাই৷ স্থানীয়দের বিশ্বাস, ঝরনার জলেই যেন অমরত্ব লাভ করেছেন লিকাই৷এই ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক তবুও নোহকালিকাই জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখতে বহুদূর থেকে মানুষজন ছুটে আসেন।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version