মাটির নীচের গুহার কথা আমরা অনেকেই জানি। চীনের চঙকিং প্রদেশের যে গুহার রয়েছে আলাদা আবহাওয়া। কেবল তাই নয়, পৃথিবীতে যেমন আকাশ রয়েছে, মেঘ এবং কুয়াশা রয়েছে, তেমনি সেই গুহার ভেতরেও রয়েছে আলাদা আকাশ, মেঘ ও কুয়াশা। আরও আশ্চর্যের হল সেই ‘ইয়ার ওয়াং ডং’ গুহার মধ্যে রয়েছে খাল, বিল, পাহাড়। মাটির নীচে আরও একটি গুহার রয়েছে ভিয়েতনামের শেষ সীমানায় লাওস সীমান্তে- ‘হ্যাং সান ডং’। মাটির নীচের শহরের কথাও আমরা অনেকে জানি। মধ্য তুরস্কের ডেরিনকুয়ে, ক্যাপাডোসিয়া অন্যতম নাম। মাটির নীচে গুহা, শহর আবিস্কারের পরে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মনে হয়েছিল তাহলে মাটির নীচে বনাঞ্চল থাকা সম্ভব! ভাবতে অবাক লাগলেও ভাবনাটি সত্যি। চীনের বিজ্ঞানীরা মাটির ৬৩০ ফুট গভীরে সিঙ্কহোলের খোঁজ পেয়েছিলেন। আর সেই সিঙ্কহোলের ভেতরে আবিস্কৃত হয়   বিশাল এক বনাঞ্চল।

সেই সিঙ্কহোলটির অবস্থান কাউন্টির পিংই গ্রামের কাছে গুয়াংজি ঝুয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে। সিঙ্কহোলটির গভীরতা ৬৩০ ফুট, দৈর্ঘ্য ১০০০ ফুট ও প্রস্থ ৪৯০ ফুট। বিশাল সেই সিঙ্কহোলটির ভেতর রয়েছে বনাঞ্চল।সেখানে যেমন ছোট গাছ আছে তেমনই আছে বিশালাকার গাছ। ওই গাছগুলির উচ্চতা ১৩১ ফুট । মাটির নীচে থাকা গাছগুলি সিঙ্কহোলের ফাঁক দিয়ে সূর্যের দিকে মুখ করে বেড়ে উঠেছে। এর আগে মেক্সিকো, আমেরিকার কিছু অংশেও সিঙ্কহোলের সন্ধান পাওয়া যায়।  তবে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের গুয়াঞ্জি ঝুয়াং অঞ্চলের এই সিঙ্কহোলটির ভেতরকার বনাঞ্চলটি এক কথায় অসাধারণ। সাধারণ ভাবে সিঙ্কহোলে বনাঞ্চল পাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এটি অপার সৌন্দর্যে ভরপুর।

আমাদের এই পৃথিবী আশ্চর্য এক সৌন্দর্যে সাজানো। যে সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হই, কখনো কল্পনা প্রবণ হয়ে উঠি। আবার এই প্রকৃতি তার রূপ বদলায়, হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর; আমাদের সব চিন্তা-ভাবনাকে ছাপিয়ে হয়ে ওঠে হিংস্র। সৌন্দর্য গ্রাস করে বিলীন করে সভ্যতা। যার প্রমাণ বিভিন্ন প্রকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস, ভূমিকম্প, বন্যা, খরা, ভূমিধস, অগ্নুৎপাত ইত্যাদি বিপন্ন করে প্রকৃতি, জনজীবন। যা আগে থেকে আন্দাজ করা যায়, কখনো নীরবে আঘাত হানে, বিলীন করে দেয় সব। তেমনি কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই হটাৎ মাটি ডেবে বিশাল গর্তের সৃষ্টি হল।প্রকৃতিতে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া এই বিশালাকার গর্ত হল সিঙ্কহোল।

সাধারণ ভাবে বৃষ্টির জল মাটির নিচে একটি স্তরে গিয়ে জমা হয়। আমরা যখন সেই জল নিজেদের প্রয়োজনে তুলে আনি, তখন মাটির নিচে ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়। মাটির উপরিভাগের ওজন বেশি হলে ফাঁকা জায়গায় ভূমিধস হয়ে বিশালাকার গর্ত তৈরি হয়।এছাড়াও মাটির নীচে যেখানে চুনাপাথর, কার্বনেট শিলা, লবণের স্তর, পাথর, বালি ইত্যাদি বেশি পরিমাণে রয়েছে সেখানে সিঙ্কহোল হতে পারে। কারণ, ভূগর্ভস্থ জলের মাধ্যমে খনিজ পদার্থ দ্রবীভূত হয়। শিলা দ্রবীভূত হলে মাটির নীচে ফাঁকা জায়গা বৃদ্ধি পায়। ক্রমে ক্রমে ফাঁকা স্থান বৃদ্ধির ফলে মাটির উপরিভাগের ভার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। একসময় উপরিভাগের ভূমিধস ঘটে সিঙ্কহোল সৃষ্টি হয়।  

একেকটি সিঙ্কহোল আয়তনে কয়েক ফুট থেকে কয়েকশো ফুট পর্যন্ত হতে পারে, যা তৈরি হতে সময় লাগে কযেক দশক থেকে শতাব্দী। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া সিঙ্কহোলগুলি মাটির গঠন ও এর অভ্যন্তরে থাকা বিভিন্ন ধরনের খনিজ ও শিলার উপর ভিত্তি করে কয়েক ধরনের হতে পারে; যেমন- ডিসসল্যুশন সিঙ্কহোল, কভার-সাবসিডেন্স সিঙ্কহোল এবং কভার কোলাপ্স সিঙ্কহোল।

চীনের দুর্গম ইয়ার ওয়াং ডং সিঙ্কহোলে স্থানীয় বাসিন্ধা ছাড়া বাইরে কেউ যাতায়াত করতো না, যখন গুহা বিশেষজ্ঞ এবং ফটোগ্রাফারদের  একটি দল ওই সিঙ্কহোল আবিষ্কার করে ভেতরের বেশ কিছু দুর্লভ ছবি তুলে নিয়ে আসেন। তখন জানা গেল ওই সিঙ্কহোল এত বিশাল যে তার উপরের অর্ধেক অংশ পুরোটাই কুয়াশা এবং মেঘে ঢাকা। সিঙ্কহোলের ভেতরে জলও রয়েছে যার স্বাদ নোনতা, একেবারেই পান যোগ্য নয়।  ইয়ার ওয়াং ডং -এর ভেতরের গভীরতা এতটাই বিশাল যে সেখানে শীতল ও আর্দ্র আবহাওয়ায় স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস  নেওয়াটা অনেক কষ্ট সাধ্য। জলের পরিমাণও এতোটা বেশি যে, সেখানে বিশাল বিশাল স্রোতের ধারা বয়ে যাচ্ছে। 

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version