গাজার ধ্বংসস্তূপের কবি তোহা অকপটে বলেছেন, গাজায় যা ঘটছে তা যুদ্ধ নয়, কারণ ফিলিস্তিনি জনগণ কয়েক দশক ধরে দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাই এটি ‘যুদ্ধের কবিতা’ হতে পারে না। বরং তিনি এটিকে বিপর্যয়ের কবিতা বলেই মনে করেন। তাঁর যুক্তি প্রতিটি কবিতাই একটি বিপর্যয় নিয়ে –‘একটি মেয়ের মৃত্যু, একজন পিতার মৃত্যু, একটি ঘর হারানো, একটি বাগান হারানো, সমুদ্র হারানো, আকাশে মেঘের মৃত্যু; যা আমরা উপভোগ করতে পারিনি’। ফিলিস্তিনি কবি তোহা দ্য নিউইয়র্কার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধের জন্য ‘ভাষ্য’ বিভাগে ২০২৪ সালের পুলিত্জার পুরস্কার জিতেছিলেন। কমিটি তাঁর গাজায় শারীরিক ও মানসিক হত্যাকাণ্ডের উপর প্রবন্ধের প্রশংসা করেন। একটি সাক্ষাৎকারে তোহা নিজেই বলেছেন, ‘হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি এই সত্যটি এক জিনিস, এবং আমি যে লেখা চালিয়ে যেতে পারি, তা অন্য জিনিস। কারণ অনেক মানুষ নৃশংসতার হাত থেকে বেঁচে আছে। এমন নয় যে তারা চুপ করে ছিল, কিন্তু তাদের চুপ থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল, কারণ তারা এখনো মানসিক আঘাতে ভুগছে। আমি নিজেও মানসিক আঘাতে ভুগছি।’

কবিতা সম্পর্কে তোহার বক্তব্য, ‘আমি মনে করি যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিফলিত করার জন্য কবিতা সবচেয়ে সফল মাধ্যমগুলির মধ্যে একটি। আমি কল্পনাও করতে পারি না যে আজকাল একজন চিত্রশিল্পী যুদ্ধ সম্পর্কে কিছু আঁকবেন। আমি কল্পনাও করতে পারি না যে আজকাল কেউ যুদ্ধ সম্পর্কে একটি উপন্যাস লিখবেন। আমি মনে করি কবিতা সম্ভবত বোমাবিধ্বস্ত শহরের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে আসা হাতিয়ারগুলির মধ্যে একটি। ইসরায়েল শুধু ঘরবাড়ি ধ্বংস করছে না, তারা শহরটিকেই ধ্বংস করছে। আপনি যদি গাজার দিকে তাকান, এটিকে কোনো শহরের মতো হবে না। এটি আসলে একটি কবরস্থানের মতো দেখাবে। আমার মনে হয় কবিতা যুদ্ধ এবং অবরোধের ভয়াবহতা প্রকাশের সবচেয়ে সরাসরি উপায়।’

ইসরায়েলি বর্বরতায় প্রতিদিন দেশবাসীকে মরতে দেখা এই কবি স্বাভাবিকভাবেই দাবি করতে পারেন, ‘গাজা একটি উন্মুক্ত কারাগার, কিন্তু আসলে এটি কোনো কারাগার নয়। আমি চাই এটি একটি কারাগার হোক। কারা কারাগারে বোমা মারে? কারা কারাগারের ভেতরে থাকা মানুষকে অনাহারে রাখে?’ তাঁর সাহসী উচ্চারণ, ‘প্রতিটি ঘরই আমার হৃদয়…পৃথিবীর প্রতিটি গর্তই আমার ক্ষত।’ মাহমুদ দারবিশ, গাসান কানাফানি থেকে শুরু করে হেবা আবু নাদা, মোসাব আবু তোহা প্রমুখ ফিলিস্তিনি কবিরা কবিতা ও ভাষা নিয়ে লড়ে যাচ্ছেন। মাহমুদ দারবিশকে গৃহবন্দি থাকতে হয় বছরের পর বছর, কানাফানিকে গুপ্তহত্যার শিকার হতে হয়। গাজায় বিমান হামলা চালিয়ে হেবা আবু নাদার কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। এর দিনকয়েক আগেই এই মহিলা কবি ও ঔপন্যাসিক লিখেছিলেন, ‘রকেটের আলো ছাড়া গাজা অন্ধকার, বোমার শব্দ ছাড়া গাজা নীরব, প্রার্থনা ছাড়া আর সব কিছুই ভয়ংকর, শহীদের আলো ছাড়া সব কিছুই কালো। শুভ রাত্রি, গাজা!’

কবি তোহা গাজায় যেদিন ইসরায়েলের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সেদিনই নিউইয়র্কার তাঁর একটা লেখা ছাপিয়েছে। শিরোনাম ছিল ‘দ্য ভিউ ফ্রম মাই উইনডো ইন গাজা’। তাতে লিখেছিলেন, ‘কাগজে লিখে ইসরায়েলি সতর্কবাতা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশে। ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ যেকোনো সময় বোমা হামলা হতে পারে।’ তোহা কবিতার মাধ্যমে গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনের নিপাট অভিজ্ঞতা এবং মানবতার শতাব্দী কাঁপানো আর্তনাদকে তুলে ধরেছেন। স্বপ্ন দেখিয়েছেন বাঁচার। গাজার ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি যে অনাবিল শব্দ-জগৎ সৃজন করেছেন, তা শুধু প্রতিরোধের ভাষা নয়, বরং এক নতুন স্বপ্নের কথাও বলে চলে। তাঁর কবিতার বিশেষত্ব হল, তিনি শুধু ফিলিস্তিনের সংকটের কথা বলেন না, বরং মানুষের একত্র হওয়ার এবং একটি শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ নির্মাণের কথাও বলেন। তিনি জানেন, যুদ্ধের পরে মানুষের জন্য এক নতুন জীবনের সূচনা হয়, এবং এই বিষয়ে তাঁর কবিতাগুলিতেই নানা ভাবনার দেখা মেলে। তোহা তাঁর প্রথম কবিতার সংকলন Things You May Find Hidden in My Ear-এর একটি কবিতায় লেখেন: ‘আমি এমন এক জায়গায় বাস করি যেখানে জল নেই, কিন্তু রক্ত আছে, যেখানে আকাশভরা ড্রোন, কিন্তু মাটিতে কোনো রুটি নেই।’ তাঁর কবিতায় যুদ্ধের তীব্রতার পাশাপাশি শান্তির আকাঙ্ক্ষাও অনন্যভাবে ফুটে উঠেছে, ‘আমার প্রতিবেশী একটি তাঁবুতে জন্মেছে, আমার বন্ধু একটি তাঁবুতে জন্মেছে, আমি নিজেও একটি তাঁবুতে জন্মেছি, তাহলে আমার সন্তানদের জন্ম কোথায় হবে?’

আবু তোহার কবিতা ফিলিস্তিনিদের জীবনের গভীর বাস্তবতা, যুদ্ধের নিঃস্বতা, এবং মানবতার প্রতি আকুতি নিয়ে কথা বলে। “ছাইয়ের মধ্যেও/ একটি ফুল ফুটতে পারে/ সবচেয়ে অন্ধকার রাতেও/ একটি মোমবাতি জ্বলে উঠতে পারে।” লাইনগুলি প্রমাণ করে যে, প্রতিটি বিপর্যয়ই নতুন আশার জন্ম দেয়। তাঁর সাহিত্য প্রতিরোধের এক নিঃশব্দ অথচ প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর। তাঁর লেখায় প্রতিটি শব্দ শুধুমাত্র ফিলিস্তিনের অবস্থার চিত্রায়ণ নয়, বরং এটি বিশ্ববাসীর কাছে একটি আবেদন—বিবেককে জাগ্রত করার। তিনি বিশ্বাস করেন, যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ থেকে কবিতার মাধ্যমে মানবতার পুনর্নির্মাণ সম্ভব। তোহার জীবন এবং সাহিত্য আমাদের শেখায় কীভাবে সংগ্রামের মধ্যেও সৃষ্টিশীলতার আলো জ্বালানো সম্ভব। তার কবিতাগুলি ধ্বংসাবশেষ থেকে জন্ম নেওয়া স্বপ্নের গল্প, যা কেবল ফিলিস্তিন নয়, সমস্ত শোষিত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা। তার সাহিত্যিক যাত্রা একটি প্রমাণ যে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে কবিতাই হতে পারে শান্তি এবং মানবতার সর্বোত্তম হাতিয়ার।
