একটি বাসের নাম- বিপ্লবী? নামে কিই বা এসে যায়! কত কিবা নাম হতে পারতো বাসটির! অন্যের মতো আমারও কৌতুহল জাগে নামের ইতিহাস বা নেপথ্যের কথাটি জানতে। 

তখন আশির দশকের মাঝামাঝি। লালবাজারের বাসিন্দা শ্রদ্ধেয় জয়ন্ত‌ সরকারের বাড়ির বারান্দায় বসে জেনেছিলাম এক মহান ও গৌরবময় ইতিহাস। আমার জানার আগ্ৰহ থেকে বক্তারই আগ্ৰহ বেশি কাহিনি জানাতে। কেতাবি চেহারার ধোপদুরস্ত এই  জয়ন্ত বাবু। তাঁর একটি বিসদৃশ ডাকনামও ছিল। মাথা ভর্তি কুঁচকানো চুল, মাঝে সিতে কাটা। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। জানতে এসেছিলাম বাসটির নামকরণের ইতিহাস। অথচ তিনি নিজেই বলে চলেছেন স্বাধীনতা যুদ্ধের এক রোমহর্ষক কাহিনি।

এই কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র তাঁরই পিতৃদেব, দেশবরেণ্য অমর বীর- বিভূতিভূষণ সরকার। যিনি ছিলেন মাতৃমন্ত্রে দীক্ষিত ও ঋষি অরবিন্দের মন্ত্রশিষ্য। ব্রিটিশদের ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। এই উনিশ বছরের আগুন পাখির কাঁধে ভার পড়েছিল জঙ্গলমহল অপারেশনের। উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ল্যান্ডমাইন বিষ্ফোরণের মাধ্যমে লাটসাহেব (বাঙলার গভর্নর জেনারেল) এন্ড্রু ফ্রেজারকে নির্মমভাবে হত্যা করার। মুরারীপুকুর বাগান বাড়িতে এই কঠিন কঠোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। তাঁকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পছন্দ মতো সহযোদ্ধাকে সঙ্গে নিতে। বিভূতিভূষণের সঙ্গে ভীষন অন্তরঙ্গ সখ্যতা ও সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ডাকাবুকো প্রফুল্ল চাকীর। বিভূতির মতো প্রফুল্লও রংপুর থেকে কলকাতায় এসেছিলেন জাতীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে।

তখন মুরারীপুকুর বাগান বাড়ি হয়ে উঠেছিল বিপ্লববাদের তীর্থভূমি। একে একে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসছেন ভারত মায়ের আগুনপাখির দল। ততদিনে কলকাতা, বাঙলাদেশ, মেদিনীপুর, বাঁকুড়ার মাটিতে গড়ে উঠেছে কংগ্রেস, যুগান্তর, বি.ভি,  অনুশীলন সমিতি, শ্রীসঙঘ-সহ আরও দুয়েকটি শাখা সংগঠন। মুরারীপুকুরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে চলত “মেদিনীপুর ছাত্র ভান্ডার”। সেখানে অকুতোভয় ক্ষুদিরাম, সত্যেন বোস, হেমচন্দ্র দাস কানুনগো, কানাইলাল দত্ত-সহ এক ঝাঁক বীরসন্তানেরা চালিয়ে যাচ্ছেন বৈপ্লবিক কর্মসূচি। কলকাতা থেকে আসছেন অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রনাথ ঘোষ। সশ্স্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করতে নয়া দিকনির্দেশ ও রূপরেখা গড়ে তুলতেই তাঁদের এই যাতায়াত।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মতো ১৯০৭-এর ৩ ডিসেম্বর বিভূতিভূষণ সরকার, প্রফুল্ল চাকী, উল্লাসকর দত্ত ও বারীন্দ্রনাথ ঘোষ মুরারীপুকুর থেকে রাতের অন্ধকারে রওনা হলেন হাওড়া স্টেশনে। এখান থেকে পুরী প্যাসেঞ্জার ধরে চললেন খড়্গপুর হয়ে বেনাপুর স্টেশন। ট্রেন থেকে নেমে পায়ে হেঁটে নারায়ণগড়ের দিকে পৌঁছালেন। রেইকির মাধ্যমে  বিস্ফোরণ স্থল পছন্দ করে লাইন খুঁড়ে মাইনের সঙ্গে ডিটোনেটর সংযোগ করে প্রতিস্থাপিত হলো বিষ্ফোরক সামগ্ৰী। ঘন্টাখানেক সময় ব্যায় করে নিখুঁত ছঁক চূড়ান্ত হয়ে গেল। বিভূতিভূষণ ও প্রফুল্লকে ইতি কর্তব্য বুঝিয়ে বারীণ আর উল্লাসকর নারায়নগড়ে ফিরলেন। এখানে মাদ্রাজ মেলে চড়ে ফিরে আসবেন কলকাতায়‌।

( বাকিটা  আগামীকাল )

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version