ডাকবাংলো কথাটির সোজাসাপটা অর্থ হল সরকারী কর্মচারীদের পান্থশালা বা সরাই। আর একটি অর্থ হল ডাক-বাহী ঘোড়ার ও আরোহীর রাত্রি যাপনের ঘর। ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলে যেসব সাহেবরা (সরকারি দায়িত্ব পালন করতে আসা সিভিলিয়ান বা পুলিশ-সেনাবাহিনীর কর্তারা) এসেছিলেন, তাদের অনেকেই কর্মস্থল ছেড়ে প্রায়ই চলে যেতেন নানা দুর্গম এলাকায়। তখন তারা ঠাঁই গাড়তেন সেই সব এলাকার ডাকবাংলোয়। এছাড়া কোনো জায়গায় যাওয়ার সময় রাত্রি হয়ে গেলে আশ্রয়ের জন্য খোঁজ পড়ত ডাকবাংলোর। ডাকবাংলো আদতে ভ্রমণকারীদের জন্য সরকারি উদ্যোগে তৈরি হওয়া রেস্টহাউজ। যার ছাদের তলায় শুধু একটি ঘরে থাকবে একখানা করে টেবিল, খাট, একটি স্নানঘর আর অবশ্যই সেখানে এক ডাকে হাজির হবে একজন খানসামা কাম কেয়ারটেকার, যে কিনা হাট বাজার করে এনে রান্নাবান্না করে দিতে পারে।  

সেকালের ডাকবাংলোগুলির অন্যতম আকর্ষন ছিল শিকার। উনিশ শতকের শেষার্ধে মুর্শিদাবাদে কর্মরত সিভিলিয়ান ডব্লিউ এইচ ফ্লরিও হুইস্টন নিজের শিকার-অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন ‘পেন অ্যান্ড পেন্সিল স্কেচেস’। সেই বই থেকে জানা যায়,  ভাগলপুরের এক ডাকবাংলোয় হুইস্টন মাঝে মাঝেই যেতেন বন্ধুদের সঙ্গে শিকার করতে। নদীর ধারের সেই বাংলোয় থেকে আশপাশের জঙ্গলে শিকার করতেন। বাংলোয় ফিরে শিকার করা প্রাণী ঝলসে খেতেন। বিশেষ করে তেল-চর্বি-স্বাদে ভরপুর  মোরগ। আর বাংলোর খানসামার রান্নার হাতও ছিল দারুণ। প্রায় ৪০ বছর ধরে কর্মরত পুলিশ কর্মকর্তা সিএ গোল্ডসবুরি তার শিকারস্মৃতি ‘টাইগারল্যান্ড’-এ লিখেছেন, বন্ধুর আমন্ত্রণে শিকারের জন্য বাংলার এক জেলায় গিয়ে কেবল বাঁশের তৈরি ডাকবাংলোয় থাকার কথা। পূর্ব বাংলার নোয়াখালী অঞ্চলে কালেক্টর পদে কর্মরত ফ্রাঙ্ক বি সিমসন তার স্মৃতিকথা ‘লেটারস অন স্পোর্টস ইন ইস্টার্ন বেঙ্গল’-এ লিখেছেন, চর হিঙ্গুটিয়া নামের এক এলাকার ডাকবাংলোর কথা। সিমসন তাঁর বইতে দাউদকান্দির একটি ডাকবাংলোরও কথা লিখেছেন। যেখানে বুনো ঘাসের বনে বন্য শূকরের দেখা মিলতো।

তবে আবহাওয়ার কারণে, দার্জিলিংয়ের ডাকবাংলো ছিল সব ইংরেজ সাহেবেরই প্রিয়। বিচারক হিসেবে কাজ করতে আসা উইলিয়াম টেইলর দুই খণ্ডে সুবিশাল আত্মজীবনী ‘থার্টি-এইট ইয়াস ইন ইন্ডিয়া’-য় দার্জিলিংয়ের পাঙ্খাবাড়ির ডাকবাংলোর প্রশংসা করেছেন। ডাকবাংলোয় খানসামার রান্না করা মুরগির মাংস তথা সুবিখ্যাত ‘ডাকবাংলো চিকেন’-এরও প্রশংসা করেছেন। উনিশ শতকের বাংলার একাধিক ডাকবাংলোর বিবরণ মেলে বেঙ্গল সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের ডব্লিউ এস বার্ক-এর লেখা বই ‘সাইক্লিং ইন বেঙ্গল’-এ। কলকাতা থেকে বর্ধমান যাওয়ার পথে পাণ্ডুয়া এলাকার একটি বাংলোর যেমন বর্ণনা দিয়েছেন, তেমনই গিরিডির বাগোদর এলাকার ডাকবাংলোর উল্লেখ করেছেন। আসলে ডাকবাংলো ছিল সেকালের ইংরেজদের আভিজাত্য, অ্যাডভেঞ্চারপ্রীতি ও রসনার প্রতীক। ইংরেজ সিভিলিয়ান বা পুলিশ-সেনাবাহিনীর কর্তাদের স্মৃতিকথায় ডাকবাংলো ঘিরে নস্টালজিয়ার প্রকাশ তারই প্রমাণ।  তবে ডাকবাংলোগুলি দেশীয় কায়দায় তৈরি হলেও ‘এলিট’ ইংরেজরাই ভোগ করতেন।‘নেটিভদের’ সেখানে ঠাঁই হতো না। তবে শাসকের ধামাধরা কিংবা টাকা-পয়সাওয়ালা স্থানীয় ‘নেটিভরা’ কখনো সখনো ঠাঁই পেতেন। এখন ডাকবাংলির দায়িত্ব রয়েছে জেলা পরিষদের হাতে আর সার্কিট হাউস ডেপুটি কমিশনার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিয়ন্ত্রণে।  

বিভিন্ন সুত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, ১৯২০ সালেও ওই সব ডাকবাংলোর ভাড়া ৮ আনার বেশি ছিল না। ডাকবাংলোতে স্ত্রী নিয়ে থাকারও সুযোগ ছিল, তার জন্য বাড়তি ৪ আনা গুনতে হতো। তার মধ্যে বাড়তি বিছানা, বালিশেরও ব্যবস্থা হতো। বেশ কয়েক বছর আগে ডাকবাংলোর ভাড়া ৮ টাকা বাড়ানো হয়। তাতে দুজনের জন্য খাট থাকায় স্ত্রীকে নিয়ে থাকলেও ৮ টাকার বেশি কাউকে দিতে হতো না।ব্রিটিশ আমলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোনো ঘর থাকার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীতে সেই ব্যবস্থা হয়।

ডাকবাংলোর সঙ্গে ইংরেজ পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন রুডিয়ার্ড কিপলিং। গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোডের ডাকবাংলো নিয়ে কিপলিং লিখেছেন ‘মাই ওন ট্রু ঘোস্ট স্টোরি’। ‘শেষের কবিতা’, ‘জীবনস্মৃতি’, ‘গোরা’ উপন্যাসে… রবীন্দ্রনাথ তো বটেই, শরৎচন্দ্রও ডাকবাংলোকে এড়িয়ে যাননি। ‘চন্দ্রনাথ’ উপন্যাসে ডাকবাংলার দেখা মেলে। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের অনেকেই তাদের রচনায় পুরনো দিনের ডাকবাংলোগুলোকে তুলে এনেছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনীতে ডাকবাংলো  আছে, মনোজ বসুর নাটকের নাম ডাকবাংলা। বুদ্ধদেব গুহর ঋজুদার সব কাহিনীতেই আছে ডাকবাংলো, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অন্ধকারের আগন্তুক’ উপন্যাসে ডাকবাংলোর উল্লেখ আছে।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার নামই ‘ডাকবাংলোতে’

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version