ক্যালেন্ডারের হিসেবে মাত্র একদিন আগে পরে জন্মেছিলেন দুই বাঙালি, তাঁরা পরবর্তীতে পরস্পরের বন্ধু হয়েছিলেন। ১৮৯৭-এর ২২ জানুয়ারি দিলীপকুমার রায়ের জন্ম নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর গ্রামে আর একই বছর সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ২৩ জানুয়ারি উড়িষ্যার কটকে৷ বন্ধু হলেও দু’জনের সাধনার পথ একেবারেই আলাদা, রবীন্দ্রনাথের ‘স্নেহের মন্টু’, শরৎচন্দ্র, অতুলপ্রসাদ, নজরুলের চোখের মণি, গান্ধী,  রোম্যাঁ রোঁলা, বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর লেখা-গান-পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ, তিনি শ্রীঅরবিন্দের মানসসন্তান, তাহলেও উত্তরকালে দু’জনের মূল্যায়ন হল ভিন্ন! একজন হয়ে উঠলেন বাঙালি জীবনের এক নতুন আদর্শ, অন্য জনকে তাঁর প্রতিভার সমস্ত সম্ভাবনা সত্ত্বেও বাঙালি বিলকুল ভুলে গেল৷

দিলীপকুমার রায় এক বিশ্বতোমুখী প্রতিভা। তবু বলতেই হয় তাঁর আসল পরিচয় তাঁর গান। যে গান শুধু গান নয়, তিনি আহৃত ও উপলব্ধ সঙ্গীতকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু শুধু সঙ্গীত নয়, সঙ্গীত যদি তাঁর প্রথম প্রেম ও প্রথম পরিচয় হয়, তাহলে দিলীপকুমারের দ্বিতীয় পরিচয় তিনি একজন স্বকীয় সাধনায় উত্তীর্ণ প্রথম শ্রেণীর সাহিত্যিক। গানের জগৎ থেকে তিনি উঠে আসেন সাহিত্যের জগতে। বাংলা-ইংরেজি মিলে তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় একশো। যার মধ্যে উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ভ্রমণকাহিনী, রমন্যাস, অলৌকিক কাহিনীর বিচিত্র বিষয়-বিন্যাস।

ছোট থেকে দিলীপকুমার ওস্তাদি হিন্দুস্তানি সংগীতের অনুরাগী। বাবা দ্বিজেন্দ্রলালের বাংলা গান তাঁকে অতটা টানত না। সুর ও সংগীত তাঁর অন্তরে গেঁথে থাকলেও,  পড়াশোনাতেও ছিলেন মনযোগী। প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এখানেই সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর আলাপ ও বন্ধুত্ব। কেমব্রিজে পড়তে গিয়ে গণিতের পাশাপাশি পাশ্চাত্য সংগীতের শিক্ষা নেন, শেখেন পিয়ানো। জার্মান ও ইতালীয় সংগীত শিখতে যান বার্লিনে। সেখানে সাক্ষাৎ হয় রোম্যাঁ রোলাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, হারমান হেসের সঙ্গে। ভারতীয় সংগীত বিষয়ে বক্তৃতা করতে আমন্ত্রিত হয়ে যান সুইজারল্যান্ডের লুনাগোতে। দেশে ফিরে ভারতীয় মার্গসংগীতে তালিম নেন আবদুল করিম খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, পণ্ডিত ভাতখণ্ডের কাছে। ভারতীয় সংগীতের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে আবিস্কার করতে গানপাগল দিলীপকুমার গোটা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে সঙ্গীতবিশারদদের থেকে রাগের ভিন্ন রূপ এবং গানের সুর সংগ্রহ করে সেগুলি লিপিবদ্ধ করা এবং নিখুঁত স্বরলিপি রচনা- এ দেশে এমন কাজ কি আর কেউ করেছেন? গান আত্মস্থ করতে গিয়েছেন বাইজিদের কাছে, বাংলার কীর্তনের নানা বিভঙ্গ, তাল-রাগরাগিণীর বিস্তার বুঝতে নবদ্বীপচন্দ্র ব্রজবাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন- এই ভাবে তিনি মেতেছিলেন বাংলা গানের সঙ্গে পাশ্চাত্য সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে কোন মিড়, গমক, তানে প্রয়োজনে কীর্তনের আখর রীতির মিশেলে পরিবেশন করা যায়, তারই অভিনব পরীক্ষায়।

গানের দুনিয়ায় তিনি এক নতুন ঘরানার পথিকৃৎ। যখন টিকিট কেটে গান শোনার চল ছিল না তিনি সেই সময়ে কলকাতায় পাবলিক কনসার্ট করছেন। শুধু কি বাংলায়, আমন্ত্রণ এসেছে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে। দিলীপকুমার পন্ডিচেরিতে অরবিন্দের আশ্রমের জন্য কনসার্ট করে টাকা সংগ্রহ করতেন। যে কজন ভারতীয় বাংলা সংগীত, তথা সেই সময়ের ভারতীয় সংগীতকে বিদেশের মাটিতে পরিচিত করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে দিলীপকুমার রায় অন্যতম। পন্ডিচেরিতে যাওয়ার আগে দিলীপকুমার দুটি গান রেকর্ড করেন। তার মধ্যে একটি ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ছিল বসে সে কুসুম কাননে’, অন্যটি ছিল, ‘রাঙাজবা কে দিল তোর পায়ে’। এই গানটি লেখেন গিরীশ ঘোষ, সুর করেন দিলীপকুমার।  এই দুটি গানের রেকর্ড বিপুল পরিমাণে বিক্রি হয়। দিলীপকুমার আশ্রমেও গান বন্ধ করেননি। পন্ডিচেরি থেকে দীর্ঘদিন পর যখন কলকাতায় আসতেন, তখন গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁকে গান রেকর্ড করার জন্য অনুরোধ করত।  এইভাবে নিশিকান্তের লেখা ‘এই পৃথিবীর পথের পরে’এবং ‘জ্বলবার মন্ত্র দিলে মোরে’ গান দুটির রেকর্ড বের হয় এবং জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছায়। এই সব গানের সুবাদে নিশিকান্ত গীতিকার হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যান। নিজের লেখা গানও অন্যকে দিয়ে সুর করিয়েছেন। তাঁর লেখা ‘তব চিরচরণে দাও শরণাগতি’ হিমাংশু দত্ত-র সুরে গেয়েছিলেন দিলীপকুমার রায় ও মঞ্জু গুপ্তা।  তাঁর বিপুল জনপ্রিয় গান ‘সেই বৃন্দাবনে লীলা অভিরাম’।  

দিলীপকুমার দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, নজরুল, নিশিকান্ত প্রমুখ গীতিকারের গান স্বকণ্ঠে গেয়ে যেমন খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তেমনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের অনড় রীতি ভেঙে তাতে একটা বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে অনুমতি মেলে নি বলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া ছেড়ে দেন।দিলীপ কুমার গানকে ভেঙেচুরে নিজের ঘরানায় গাইতেন। সংগীতবোদ্ধারা তাঁর এই ঢঙকে ‘দৈলিপী ঢঙ’ নামে অভিহিত করেন। তাঁর গানের কথায় রয়েছে সুগভীর অর্থ, রয়েছে আধ্যাত্মিক ভাবনার ছাপ এবং সুরের কারুকাজ। তিনি বলতেন, ‘আই সিং হোয়াট আই ফিল’ এই অনুভবেই তিনি গেয়েছেন ‘যদি দিয়েছ বঁধুয়া’, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’, ‘জীবনে মরণে এসো’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা যত, গানে বৈচিত্রও ততোধিক। তাঁর গান সহজ নয়, গাইতে হলে বহু চর্চা ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। তাঁর গায়নভঙ্গিকে আত্মস্থ করা খুব একটা সহজ হয়নি কখনওই। তরঙ্গের মতো সুরবিন্যাস, তার সঙ্গে গানের কথার অর্থগত সাযুজ্য এবং চলনে এক আধ্যাত্মিক দর্শন সুস্পষ্ট। ওই তানকর্তব এবং ভাবপ্রবণতা অনুসরণ করে গাইতে গিয়েও খেই হারিয়েছেন অনেকেই। হয়তো তাই আজও তাঁর গান গাওয়ার লোকের বড় অভাব। বহুমুখী প্রতিভা, মনন ও মেধাসম্পন্ন চিন্তক, অনন্য গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সাহিত্যিক হয়েও তিনি উপেক্ষিত।    

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version