(গত সংখ্যার পর)

খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী পর্যন্ত গাজা ছিল টলেমি সাম্রাজ্যের অধীনে, এই সময় গাজা বন্দর হিসেবে খুব গুরুত্ব লাভ করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে সিরিয়া-সহ পুরো লেভান্ট অঞ্চল সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধীনে যায়। তখন গাজা সেলুসিড সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়। তাতে গাজার আর্থ সামাজিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। কারণ সেলুসিডদের দেবতা জিউস মারনাসের সঙ্গে গাজার দাগোন মন্দিরের তেমন বিরোধ ছিল না। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ১৮৮ সালে পরাক্রমশালী সেলুসিড সম্রাট তৃতীয় এন্টিয়োকাস রোমান সাম্রাজ্যের দিকে হাত বাড়িয়ে বড় ধরনের খেসারত দিয়েছিলেন। পরাজিত হওয়ার পর নিজের বেশকিছু অঞ্চলকে ছেড়ে দিতে হয় রোমানদের। গাজা তখনো সেলুসিডদের অধীনে থাকলেও নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে যায়। কয়েক দশক পর স্থানীয় ইহুদি উপজাতিরা সেলুসিডদের প্যাগান দেবতার উপাসনা করতে অস্বীকার করে গাজার ম্যাকাবি পরিবারের নেতৃত্বে সেলুসিড সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।ইহুদি বিদ্রোহীরা গাজায় আক্রমণ চালিয়ে বিশিষ্ট নাগরিক ও তাদের সন্তানদের জিম্মি করে জেরুজালেমে নিয়ে আটকে রেখেছিল।

বিদ্রোহের কিছুকাল পর জেরুজালেমকেন্দ্রিক হাসমোনিয়ান রাজ্যের উত্থান ঘটে। সেলুসিড সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও সেই রাজ্যটি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করত। হাসমোনিয়ান রাজ্যের উত্থান গাজার অধিবাসীদের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। বরং হাসমোনিয়ানের উত্থানে গাজাবাসী আতঙ্কে থাকত। এই অবস্থায় গাজার পাশ দিয়ে নাবাতিয়ান সাম্রাজ্যের উদ্দেশে ইয়েমেন থেকে আসা দীর্ঘ উটের কাফেলাগুলি যাতায়াত করত। গাজার শাসক সেই কাফেলার মাধ্যমে নাবাতিয়ান সম্রাটের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার চেষ্টা করত, যাতে বিপদে সাহায্য পাওয়া যায়। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব ৯৭ সালে হাসমোনিয়ান সাম্রাজ্য যখন গাজা আক্রমণ করে, তখন গভর্নর অ্যাপোলোডটাস কোনো সাহায্য পাননি। নিজের ভাইয়ের হাতে অ্যাপোলোডটাস নিহত হওয়ার পর গাজা হাসনোমিয়ানদের দখলে চলে যায়। এই সময়ে আলেকজান্ডারের ভয়ে স্থানীয় লোকজন দলে দলে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে প্রাণ রক্ষা করেছিল।

খ্রিস্টপূর্ব ৬৩ সালে রোমান আক্রমণে জেরুজালেমের পতন ঘটলে গাজায় হাসমোনিয়ান শাসনের অবসান হয়। কিন্তু গাজার ভাগ্য ঝুলে থাকে অনিশ্চয়তার দোলায়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৬ সালে রোমান সম্রাট মার্ক এন্তোনিও ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে গাজা দখল করে শহরটি তার স্ত্রী ক্লিওপেট্রাকে উপহার দেন। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে যাওয়ার পর গাজা নতুন করে জেগে উঠতে শুরু করে। গাজার বাণিজ্যিক উন্নয়নের পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য, ক্রীড়া ইত্যাদির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে। ৩১৩ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট কনস্টাইন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হওয়ার পর গাজায় খ্রিস্টধর্ম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। তখন গাজায় জিউস মারনাস নামের এক প্যাগান দেবতার উপাসনা হত। প্রথম দিকে ধর্ম নিয়ে বিবাদ ছিল। নতুন খ্রিস্টানদের ওপর আক্রমণ চালানো হত। ধীরে ধীরে খ্রিস্টধর্মই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তবে প্যাগান দেবতার উপাসনাও চলত। গাজায় খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে বাইজেন্টাইন আমলে।

গাজার ভাগ্য নতুন দিকে মোড় নেয় সপ্তম শতাব্দীতে। ৬১৮ খ্রিস্টাব্দে পারস্য সম্রাট খসরুর আক্রমণে জেরুজালেম-সহ পুরো প্যালেস্টাইন রোমানদের হাতছাড়া হয়। ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে হেরাক্লিয়াস পাল্টা আক্রমণ করে গাজাকে রোমের দখলে আনে। কিন্তু মাত্র আট বছর পর ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে এক নাটকীয় যুদ্ধে মুসলমান বাহিনীর কাছে হেরাক্লিয়াস পরাজিত হলে বাইজেন্টাইন শাসনের অবসান ঘটে। গাজার দখল চলে যায় আরবের মুসলমানদের হাতে। তখন থেকে গাজা মুসলিমপ্রধান শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম শাসকদের মধ্যেও অনেক বাদ-বিবাদ ছিল। ফলে যুদ্ধ, হানাহানি আর রক্তপাত থেকে গাজা মুক্ত ছিল না। গাজাবাসীর ওপর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা বারবার ফিরে এসেছে।

১৯৩২ সালে স্যার ফ্লিন্ডার্স পেত্রি যখন ওয়াদি গাজা অঞ্চল খনন করে চার হাজার বছর পুরনো হিকসস আমলের ফারাওদের বিপুল সম্পদ আবিষ্কার করেন, তখন গোটা পৃথিবী চমকে উঠেছিল। গাজার প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে নতুন করে গবেষণাও শুরু হয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যের এই অঞ্চলেই যে পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির জন্ম হয়েছিল তার অনেক কিছু তখনো উন্মোচন হয়নি। কিন্তু একের পর এক ঘটতে থাকা ধ্বংসযজ্ঞ আর রক্তপাতের ভেতর হাজার হাজার মানুষের পাশাপাশি হারিয়ে যেতে থাকে গাজার গৌরবময় ইতিহাসের সূত্র। যে ক্ষতি পৃথিবীর ইতিহাসের জন্য অপূরণীয়।

শেষ

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version