ইজরায়েল ও ইরান- মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলছে আট দিন ধরে। যুদ্ধে দুই দেশেরই যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হলেও উত্তেজনা প্রশমনের কোনো ইঙ্গিত মিলছে না বরং সংঘাত উত্তরোত্তর বাড়ছে। সূত্রের খবর, ইজরায়েল খামেনেইয়ের বাঙ্কার এলাকা লবিজানে হামলা চালানোর পাশাপাশি ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তালেশান গ্রামের বাসিন্দাদের এলাকা ছাড়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দাবি করেছেন, এখন আর ইরানের আয়াতোল্লা আলি খামেনেই-এর মতো ধর্মীয় শীর্ষ নেতারাও নিরাপদে নেই। অন্যদিকে, ইরানবাসীর উদ্দেশ্য়ে খামেনেই বার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, শত্রুকে ভয় পেও না, জয় আমাদের হবেই। এই অবস্থায় গোটা বিশ্বই পড়েছে উদ্বেগের মধ্যে কারণ, দুটি দেশই ক্রমশ একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে।
আমরা সবাই জানি যে, দুটি দেশই তিব্র প্রতিদ্বন্দ্বী, কিন্তু এটাও খুব আশ্চর্যের কথা যে এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সম্পর্ক কিন্তু আগে এমন ছিল না। একটা সময় ছিল যখন ইরান এবং ইসরায়েল ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল, বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর ইরান এই অঞ্চলের প্রথম দেশগুলির মধ্যে একটি যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। তখন অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি। তুরস্কের পর ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই সময়, ইরান মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের বৃহত্তম ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি আবাসস্থল ছিল এবং শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি এবং প্রথম ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়নের অধীনে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, এমনকি আরব নয় সেই রাষ্ট্রগুলির বিরোধিতা মোকাবেলায় তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা করেছিল। আরব রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করলেও ইরান ইসরায়েলের কাছে তেল বিক্রি করেছিল। উল্লেখ্য, শাহ (ঐতিহাসিকভাবে পারস্য নামে পরিচিত ইরান শাহ নামে রাজারা শাসন করতো, মোহাম্মদ রেজা পাহলভী ছিলেন ইরানের শেষ শাহ, যিনি ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে এই শাসন শেষ হয়। ইরান এবং ইসরায়েল উভয় দেশই আমেরিকার সমর্থন পেয়েছিল। পরবর্তীতে ইসরায়েল (১৯৭০-এর দশকে) তেহরানে একটি দূতাবাস স্থাপন করে এবং রাষ্ট্রদূত বিনিময় করে। দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্কও সমৃদ্ধ হয়।
কিন্তু এরপর এক দশকের মধ্যেই পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়, যেখানে শাহকে উৎখাত করা হয় এবং একটি ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামের পক্ষে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আসেন এবং ইস্রায়েলকে তাদের নিজস্ব স্বার্থে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলকারী হিসেবে দেখেন। খোমেনি ইস্রায়েলকে “ছোট শয়তান” এবং আমেরিকাকে “মহান শয়তান” বলে অভিহিত করেন। ইস্রায়েল নতুন ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিতেও অস্বীকার করে। ফলস্বরূপ, ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে, ইহুদি দেশে ভ্রমণ এবং বিমান রুট বন্ধ করে দেয়, একই সঙ্গে ইসরায়েলি দূতাবাসকে ফিলিস্তিনি দূতাবাসে রূপান্তরিত করে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে, যার ফলে সৌদি আরব এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়। ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় থাকলেও, তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। অবশেষে, সিরিয়া, ইরাক, লেবানন এবং ইয়েমেনের মতো দেশে ইরান প্রক্সি মিলিশিয়া এবং গোষ্ঠী তৈরি এবং গভীরভাবে অর্থায়ন করার ফলে দুই দেশের মধ্যে একটি ছায়াযুদ্ধ শুরু হয়। ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া প্রথম ইরান সমর্থিত ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে।
বছরের পর বছর ধরে, ইরান এবং ইসরায়েল গোপন যুদ্ধের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে একে অপরের স্বার্থের লক্ষ্য হয়ে ওঠে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যা এবং ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের পারমাণবিক স্থাপনাগুলিতে নাশকতার অভিযোগ রয়েছে – যেমন ইরানি অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার জন্য ইসরায়েল সিরিয়ার বিমানবন্দরগুলিতে বোমা হামলা চালিয়েছিল। অন্যদিকে, ইরানের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরে ইহুদি এবং ইসরায়েলি স্বার্থকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা এবং বন্দুক হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ১৯৭৯ সাল থেকে, সমস্ত ইরানি নেতা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরোধিতা করেছেন। এর বিনিময়ে, ইসরায়েল ইরানের সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও জোরদার করেছে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বিশ্বশক্তির মধ্যস্থতায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে “ঐতিহাসিক ভুল” বলে অভিহিত করার পর থেকে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয় যখন সন্দেহভাজন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ায় ইরানি দূতাবাসে বোমা হামলা চালায়। এখন ইসরায়েলি প্রতিশোধের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সম্ভাব্য সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে নেতারা উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন। যদি সত্যিই যুদ্ধ শুরু হয়, তাহলে তা ইরান-ইসরায়েল সম্পর্কের খাতায় আরও একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় যুক্ত করবে।