ব্রেকফাস্ট সেরে তিনি বাড়ি থেকে বেরলেন। পরনে কালো পাড়ের একটি গেরুয়া রঙের শাড়ি। তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার উস্তিনভের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। সফদরজঙ্গ রোডের পাশে আকবর রোডে দফতর। দুই ভবনের মাঝের লাগোয়া রাস্তা দিয়েই নিরাপত্তারক্ষী ও ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গে এগোচ্ছিলেন তিনি। ঘড়িতে তখন ন'টা বেজে দশ মিনিট, দিনটা যথেষ্ট রোদ ঝলমলে, রোদ থেকে তাঁকে আড়াল করতে সেপাই নারায়ণ সিং একটা কালো ছাতা নিয়ে পাশে পাশে হাঁটছিলেন। কিছুটা পিছনে ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান আর তারও পিছনে ব্যক্তিগত পরিচারক নাথু রাম। এদের সবার পিছনে আসছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার, সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল। ঠিক সেই সময় এক কর্মচারী পিটার উস্তিনভের জন্য হাতে একটা চায়ের সেট নিয়ে ওদের পেরিয়ে যাচ্ছিল, তিনি  ওই কর্মচারীকে ডেকে বলেন,উস্তিনভের জন্য যেন অন্য আরেকটা চায়ের সেট বার করা হয়।এরও আগে সচিব আর কে ধাওয়ানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। ধাওয়ান তাঁকে জানিয়েছলেন,নির্দেশমতো ইয়েমেন সফররত রাষ্ট্রপতি জৈল সিংকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে তিনি সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই দিল্লি চলে আসেন। সেই সময় ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। সন্ধের দিকে ব্রিটেনের রাজকুমারী অ্যানের সম্মানে একটা ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।

আচমকা কান-ফাটানো আওয়াজ। পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বার করে তাঁর দিকে গুলি চালায়।প্রথম গুলিটা এসে লাগে পেটে। তিনি ডান হাতটা ওপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালায়। সে-দুতি গুলি লাগে তাঁর বুকে আর কোমরে।ঠিক পাঁচ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতবন্ত সিং। তাঁকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সতবন্ত বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। মুহূর্তের স্তব্ধতা ভেঙে কার্বাইন চালাতে শুরু করলেন সতবন্ত। রক্তে রাস্তা ভেসে গেল। সেই রক্তের ওপর পড়ে রইল নিথর দেহ…

এই ঘটনার আগের দিন ভুবনেশ্বরে গিয়েছিলেন তিনি। সূচি অনুযায়ী মঞ্চে হাজির হয়েছিলেন বক্তৃতা দিতে। প্রতিবারের মতো এবারও ভাষণের খসড়া এগিয়ে দেন এইচ ওয়াই শারদাপ্রসাদ। কিন্তু তিনি তো খসড়ার বাইরে চলে যাচ্ছেন। ‘আমি আজ আছি, কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু আমার মনে কোনো অনুতাপ নেই। অনেকদিন বেঁচেছি। যে কদিন বেঁচেছি, দেশের কথা ভেবেছি।’ তবে কি রক্তের দাগ তিনি আগেই দেখতে পেয়েছিলেন। তা না হলে প্রতিতি কথায় আসন্ন মৃত্যুর পূর্বাভাস কেন? এমনভাবে তো এর আগে তাঁকে দেখা যায়নি! সেদিন কী হল হঠাৎ, যে তাঁর পুরো ভাবই বদলে গিয়েছিল? ওড়িশার রাজ্যপালও অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। খুব তাড়াতাড়ি দিল্লি ফিরে গিয়েছিলেন। রাতে ভাল ঘুমোননি।

এর কয়েকদিন আগে তাঁর কাছে গোয়েন্দা প্রধানরা এসে জানিয়েছিলেন, গোপন সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রীর ওপর হামলা হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তারক্ষীদের থেকে শিখদের বাদ দিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু এমন প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছিলেন ইন্দিরা। কাউকে বের করা যাবে না। প্রসঙ্গত, বেশ কয়েকটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে স্বাধীনতা দাবি করতে শুরু করেছিল ইন্দিরার ৪র্থ দফার প্রধানমন্ত্রীত্বে। যার মধ্যে অন্যতম ছিল পাঞ্জাব। সন্ত জার্নাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালের নেতৃত্বে স্বতন্ত্র ভূখন্ড ‘খালিস্তান’ এর দাবিতে শিখরা  আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮২-র জুলাই মাসে জার্নাইল সিং অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অবস্থান নেন এবং শিখ বিদ্রোহকে আন্দোলিত করেন। ১৯৮৪ সালের জুন মাসে ইন্দিরা শিখ বিদ্রোহ দমন করতে স্বর্ণমন্দিরে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে অপারেশন ব্লু-স্টার পরিচালনা করেন। ভারতীয় সেনাদের হিসাব অনুযায়ী ৪৯৩ জন শিখ বিদ্রোহী এবং সেনাবাহিনীর ৪ অফিসারসহ ৮৩ জন নিহত হন। অপারেশন ব্লু-স্টার চলেছিল ৬ জুন, যেদিন স্বর্ণমন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা অর্জন দেবের মৃত্যুবার্ষিকী। সেদিন প্রচুর শিখ তীর্থযাত্রী আসে স্বর্ণমন্দিরে। তার মানে যত বেশি সংখ্যক শিখ হত্যা করে বিদ্রোহ দমন করাই আসল লক্ষ্য। পরবর্তী সময়ে পাঞ্জাবের গ্রামাঞ্চলকে বিচ্ছিন্নতাবাদমুক্ত করতে ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনী নামানো হয়।

পবিত্র স্বর্ণমন্দিরের অবমাননা আর খালিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার প্রতিশোধ নিতে ৩১ অক্টোবর ১৯৮৪, সাৎওয়ান্ত সিং ও বেয়ান্ত সিং নামে নিজের দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে নিহত হন ইন্দিরা। শিখ দেহরক্ষী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর দেশজুড়ে দাঙ্গা বাধে। আট হাজারের মতো লোক নিহত হয়। দিল্লিতেই নিহত হয় তিন হাজার। দাঙ্গা চলে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত। সিবিআই-এর মতে দিল্লি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু কমকর্তার সহায়তায় এই দাঙ্গা চলে। মায়ের মৃত্যুর পর রাজিব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই বলেছিলেন বড় গাছ যখন পড়ে, তখন মাটি কাঁপে। দেশে জরুরি অবস্থার সময়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত হাজার হাজার শিখকে আটক করে কারাগারে রাখা হলে শিখরা মাঝে মধ্যেই হামলা চালালে সরকার বলত সন্ত্রাসবাদী। ইন্দিরা হত্যার পর সরকারি রিপোর্ট অনুসারে, দু’হাজার ৭০০ জন শিখ নিহত হয়। দিল্লি থেকে ২০ হাজার শিখ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, কংগ্রেস দলে পরিবার তন্ত্র ও হাইকম্যান্ড নির্ভরশীলতার জন্ম দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। নেহরুর জমানায় যে দলটি চলত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, ইন্দিরা গান্ধী সেই কংগ্রেস দলে হয়ে ওঠেন একনায়িকা। কংগ্রেস দলের ক্ষমতাকে তিনি যেমন সম্পূর্ণ নিজের হাতের মুঠোয় রাখতেন তেমনই যত্নের সঙ্গে পালন করতেন পরিবারতন্ত্রকে। যে কারণে ছোট ছেলে সঞ্জয়কে নিজের উত্তরসূরি ঠিক করে ফেলেছিলেন। কিন্তু বিমান দুর্ঘটনায় সঞ্জয়ের আকস্মিক মৃত্যু হলে ইন্দিরার সেই ইচ্ছা সফল হয়নি। তারপরও তাঁর পরিবারবাদ-প্রকল্প থেমে থাকেনি। তিনি বড় ছেলে রাজীবকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। কিন্তু সোনিয়া এবং রাহুলের আমলে পরিবারবাদ ও হাইকম্যান্ড নির্ভরশীলতাই দেশের সুপ্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলটির ক্ষয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে ইন্দিরা এবং রাজীব গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকান্ড দেশের সর্বপ্রাচীন দলটিকে এমন ধাক্কা মারে যে দলের শিরদাঁড়াটাই ভেঙে যায়। যে ভাঙনের শুরু হয়েছিল লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পরে। কংগ্রেসের সিন্ডিকেট ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলএকরকম ভাবনা নিয়ে। আর ইন্দিরা ক্ষমতা পাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই দল ভেঙে আলাদা দল গড়ে কংগ্রেসের প্রবীণদের প্রাধান্যকে খর্ব করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কংগ্রেস এক কেন্দ্রীভূত গোষ্ঠী যেখানে তিনিই দলের সর্বেসর্বা। কিন্তু তাঁর এই ক্ষমতায়ন ও পরিবারতন্ত্রের জাঁতাকলে কংগ্রেসের সাংগঠনিক শক্তির ক্ষয় হয়।আর ইন্দিরার একনায়িকাতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চায় কংগ্রেস দলটি স্রেফ একটি তাঁবেদারদের গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে তাঁর পুত্রবধূও সেই পরিবারবাদকেই টিকিয়ে রাখতেএবং দলটিকে আরও বেশি হাইকম্যান্ড নির্ভরশীল করতে চেয়েছেন। একসময়এ দেশে রাজনীতি চর্চায় নেহরু ও ইন্দিরা ছাড়া আর কোনও নামই প্রায় উচ্চারিত হত না। কিন্তু আজ আর তাদের নাম বিশেষ কেউ বলেন না।বোধহয় রাজনীতির ইতিহাস এভাবেই উত্তর দেয়।
Share.

2 Comments

  1. এই ঘটনা সম্পর্কিত তথ্য সহকারে লেখা এর আগে বহু মানুষ লিখেছেন, কিন্তু এটির শব্দ-সমন্বয় সেগুলির তুলনায় অনেক কম হলেও, লেখাটি অনেক বলিষ্ঠ এবং একটি অপূর্ব চিত্রনাট্য।

  2. akram sahadeo ali on

    উস্তিনভ পরে বলেছিলেন, তিনি প্রথমে তিনটি গুলির আওয়াজ শুনেছিলেন। পর মুহূর্তেই তাঁর মনে হয়েছিল, কাছেই কোথাও যেন টানা বাজি ফাটছে। বিয়ন্ত সিংকে ঘটনাস্থলেই গুলি করে মারা হয়। গুলি করা হলেও বেঁচে যায় সৎবন্ত সিং। ঘটনার প্রায় চার বছর পর প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার দায়ে সৎবন্ত এবং অন্য এক ষড়যন্ত্রকারী কেহর সিংয়ের ফাঁসি হয়। কিন্তু, ৩১ অক্টোবরের সেই রাজনৈতিক হত্যা আরও এক হত্যালীলার জন্ম দিয়েছিল। বিয়ন্ত-সৎবন্তরা শিখ হওয়ায় রাজধানী জুড়ে শিখবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। যার আঁচ পড়ে গোটা দেশেই।

Leave A Reply

Exit mobile version