কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে আসা কোচবিহার রাসমেলার গায়ে আজও লেগে রয়েছে ঐতিহ্য আর পরম্পরা। এ রাজ্যের অন্য যে কোনও মেলার থেকে যেমন প্রাচীন তেমনই বৈশিষ্টপূর্ণ। কয়েকশো বছর আগে যে রাসমেলা কোচ রাজাদের হাত ধরে শুরু হয়েছিল সেই মেলায় ধর্মীয় প্রভাব তো অব্যশই ছিল, কিন্তু মেলার গায়ে কেবল ধর্মীয় ছাপ্পা মেরে দেওয়া যাবেনা। কারণ বছরের পর বছর ধরে রাসমেলায় যে কয়েক হাজার মানুষ ছুটে আসেন তা যে কেবল ধর্মিয় উদ্দেশে তা নয়। মেলার অর্থনৈতিক কারণ তো আছেই তাছাড়াও মানুষে মানুষে মিলনও একটা বড় বিষয়। এখানে রাধাকৃষ্ণের মিলন কিংবা রাধিকানিহীন মদনমোহনের ধর্মীয় ব্যাখ্যার থেকেও মানুষের মিলন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  

শ্রাবণ পূর্ণিমায় যেমন ঝুলনযাত্রা, কার্তিক পূর্ণিমায় তেমন রাধাকৃষ্ণের লীলা সংবলিত একটি উৎসব হল রাসযাত্রা। বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক সাধনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই পালনও অবশ্যক। সংসয়াতীতভাবে হিন্দুধর্মাবলম্বী ছিল কোচ রাজ পরিবার। রীতিনীতি, আচার-আচরণেও হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা বা ভক্তিতে কোনও ফাঁক ছিল না। একদিকে শক্তিদেবী ভবানী বা ভগবতীর উপাসনাও যেমন তাঁরা করতেন, অন্যদিকে বাণেস্বর, সিদ্ধনাথ, হিরণ্যগর্ভ শিব মন্দির নির্মাণ করে নিত্যপুজোর আয়োজনও রেখেছিলেন। কোচ রাজপরিবার শাক্ত ও শৈব দুই ধর্মের প্রতি অনুগত ছিলেন। কিন্তু তারপরেও কোচ রাজবংশের কুলদেবতা হলেন মদনমোহন। আর এই মদনমোহনকে ঘিরেই কোচবিহার রাসমেলা। রাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলের আগে পর্যন্ত মদনমোহনের পূজা হত কোচবিহার রাজবাড়ির ভেতরে। পরে বৈরাগী দিঘির উত্তর ধারে ১৮৯০ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ নির্মাণ করেন মদনমোহন মন্দির। সেই মন্দিরের সামনে বৈরাগী দিঘীর পাড়ে কার্তিক পূর্ণিমায় রাস উৎসবকেন্দ্র করে মেলা বসতে শুরু করে। যদিও এই মেলা ১৮১২ সালে শুরু হয়েছিল তৎকালীন কোচবিহার রাজ্যের রাজধানী ভেটাগুড়িতে।

প্রসঙ্গত, কোচবিহার রাজবাড়ির কুলদেবতা মদনমোহন সেই সঙ্গে রাসউৎসব উপলক্ষে রাসমেলার প্রাচীনত্ব নিয়ে সংশয় এবং বিতর্ক দুই রয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি কোচবিহার রাজপরিবারের বৈষ্ণব ধর্মপ্রীতি নিয়েও যে প্রশ্ন ওঠে সেটিও খুব একটা অসংগত নয়। যে রাজপরিবার শাক্ত ও শৈব দেবদেবীর মন্দির নির্মাণ করিয়ে নিষ্ঠা সহকারে তাঁদের নিত্যপুজোর ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই পরিবারই আধ্যাত্মিক বিচারে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অতীব গুরুত্বপূর্ণ পালনীয় উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতা করলেন কেন?

একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের সুযোগ্য পুত্র নরনারায়ণ থেকে শুরু করে সর্বশষে রাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ এদের প্রত্যকের নামের শেষ অংশে নারায়ণ রয়েছে। নামের অন্তে দেবতা বিষ্ণু বা নারায়ণ নাম ব্যবহার স্পষ্টভাবেই বুঝিয়ে দেয় যে, কোচবিহার রাজবংশের নৃপতিরা বংশপরম্পরায় বিষ্ণুভক্ত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ওই কুড়িজন রাজার মধ্যে অনেকেই ছিলেন পরম বৈষ্ণব। এ কথাও জানা যায় যে, রাজা নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ আসামে বৈষ্ণবধর্মের অন্যতম প্রচারক শঙ্করদেবের প্রবর্তিত ধর্মমতকে রাজধর্ম বলেও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক বৈষ্ণবসাধক শঙ্করদেব অবশ্য তাঁর সাধনায় কেবলমাত্র কৃষ্ণরই অনুরাগী ছিলেন। চৈতন্যদেবের কাছে শ্রীরাধিকা হলেন কৃষ্ণপ্রেম ও কৃষ্ণভক্তির মহোত্তম প্রকাশ। কারণ গৌড়ীয় সাধনার মূলে রয়েছে রাধাকৃষ্ণ যুগল উপাসনা। কিন্তু শঙ্করদেব বা তাঁর মতাবলম্বীরা অবশ্য শুধুই কৃষ্ণ-অনুরাগী ছিলেন। রাধিকার কোনও ভূমিকা ছিল না তাঁদের উপাসনায়।

কোচবিহার রাজপরিবরের কুলদেবতা মদনমোহন রাধাবিহীন। একা মদনমোহনই রাজপরিবারের উপাস্য। তাহলে কোচবিহারের রাস উৎসব আর তাঁকে ঘিরে মেলার তাৎপর্য কী? বাংলা সনের সপ্তম মাসের শুক্লাপক্ষের পঞ্চদশ তিথিতে শ্রীরাধিকা ও কৃষ্ণের মিলন উপলক্ষ্যেই রাস উৎসব। অন্তত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মমত সে কথাই বলে। আর সেই কারণেই বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীদের কাছে এই উৎসবের মাহাত্ম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বভাবতই রাধাকৃষ্ণের উপাসকরা এই উৎসবকে পালন করে তাঁদের সাধনা রীতিতেই। কিন্তু কোচবিহারের রাজপরিবারের কুলদেবতা মদনমোহন তিনি তো শ্রীরাধিকাবিহীন। অন্যদিকে, যে শঙ্করদেবের প্রভাবে রাজপরিবার বৈষ্ণবধর্মের অনুরাগী, সেই বৈষ্ণবীয় সাধনাতেও শ্রীরাধিকার কোন ভূমিকা নেই। ফলত, কোচবিহার রাসমেলাকে কেবলমাত্র ধর্মীয় প্রেক্ষিত অথবা বৈষ্ণবীয় লীলা অনুষঙ্গে আজ বিচার করতে যাওয়া মস্ত ভুল হয়ে যাবে।

তবে কালে কালে এই মেলা মানুষের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। ধর্মীয় অনুষঙ্গের পাশাপাশি সামাজিক প্রেক্ষাপটও বড় হয়ে উঠেছে। বদলও ঘটেছে অনেক। কিন্তু সেই বদল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। রাজ-অনুগ্রহেই যে এই মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল, ধর্মীয় আনুগত্য থেকেই যে তাঁর সূচনা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সেসব কিছু ছাপিয়ে মেলার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ।এখানে রাধাকৃষ্ণের মিলন কিংবা রাধিকানিহীন মদনমোহনের ধর্মীয় ব্যাখ্যার থেকেও মানুষের মিলন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে মেলার বাইরের চেহারার বদলের থেকেও লক্ষনীয় ব্যাপার হল তাঁর যুগোপযোগিতা।
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version