রবীন্দ্রনাথের ‘মুসলমানির গল্প’ কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরানী’ অথবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ বাংলা সাহিত্যে যেমন ডাকাতদের অবাধ বিচরন তেমনি সুদূর অতীত থেকে পুরাণ, মহাভারত এমনকি জাতকের কাহিনিতেও মেলে ডাকাতদের কথা। প্রসঙ্গত, রাতে ডাকাতি করলেও দিনে তারাই কৃষিজীবী অথবা নৌকার মাঝি হয়ে গোপনে বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করত, শরীরকে মজবুত রাখতে ডন-বৈঠক, রায়বেঁশে নাচ ইত্যাদি অভ্যাস করত।

শোনা যায় বিশে ডাকাত ধনীদের সম্পদ লুঠ করে গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিত। সে সোনার গয়না পরে পালকিতে ঘুরে বেড়াত। ধনীদের লুঠ করা ছাড়াও অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধেও সে রুখে দাঁড়িয়েছিল।তবে ডাকাত মানেই জমিদার বা ভূস্বামী বিরোধী কিন্তু নয়! অনেক জমিদার ডাকাত দল পুষতেন এবং সেই দলের সাহায্যে পাশের জমিদারের সম্পত্তি লুঠ করত। কথিত, মহিষাদলের রাজার মাইনেভুক্ত ডাকাত দল ছিল, বর্ধমান বা বীরভূমের বহু জমিদারদেরও ছিল পোশা ডাকাত দল। অনেক সময় ধরা পড়লে শাস্তি হিসাবে তাদের ডান হাত আর বাঁ পা কেটে নেওয়া হত। নীল বিদ্রোহ থেকে সাধীনতা সংগ্রামে বেশ কয়েকজন ডাকাতের নাম জড়িয়ে আছে যারা মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে স্বসস্ত্র বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল| আজ এরা ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছে।  

কথিত রয়েছে, সপ্তমগ্রাম বন্দরে কোনও জাহাজ এসে দাঁড়ালেই তা লুঠ করতে রঘু ডাকাতের দল। এই লুঠতরাজের সাফল্যের কারণেই রঘু ডাকাত বাঁশবেড়িয়ার ত্রিবেণীর কাছে তাঁর ডাকাত কালী প্রতিষ্ঠা করেছিল। যেখানে প্রতিদিন কালীকে পোড়া ল্যাটা মাছ অর্পণ করে রঘু ডাকাত ডাকাতি করতে বের হত। শোনা যায়, চন্দননগরের অনতি দূরে হুগলির বাঁশবেড়িয়ায় একসময় রঘু ডাকাত ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। তার দল নীলকর সাহেবদের হত্যা করে তাদের গাছে ঝুলিয়েও অনেক সময় পালিয়ে যেত।  

একসময়ে হুগলীর জিরাটের জমিদার কালিচাঁদকে সকলে কেলে ডাকাত বলেই চিনত। সেই জমিদারের প্রতিষ্ঠিত মন্দির কালীর গড়ে আজও পুজো হয়। জিরাটের কালীগড়ের কালী সম্পর্কেও রয়েছে ডাকাতিকে কেন্দ্র করে এক অজানা কাহিনি। বহু বছর আগে নাকি, এই এলাকার জমিদার কালী পুজোর পর বেড়িয়ে পড়তেন ডাকাতিতে। যদিও তা অস্বীকার করেন পরিবারের সদস্যরা। উল্লেখ্য, কালীগড় থেকে এই এলাকার পুজোর

বাংলার আরেক কুখ্যাত ডাকাত ছিল প্রল্হাদ। শোনা যায়, এককালে প্রহ্লাদ ডাকাত  কেতুগ্রামের রামসীতা মন্দিরের স্বর্ণালঙ্কার ডাকাতি করতে গিয়ে পথে ডাকাতদলের একজন এক মহিলাকে আক্রমণ করে। ডাকাতদলের নেতা প্রহ্লাদ সর্দার মহিলা-স্পর্শের অপরাধে সেই সদস্যকে এক কোপে ছিন্ন করে দেয়। এরপরই ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ সন্দেহবশত ওই মহিলাকে জিজ্ঞাসা করে, তিনি কে? জবাবে মহিলা অলৌকিকভাবে কালীমূর্তি ধারণ করেন। এরপর থেকেই প্রতিষ্ঠিত বামা কালীর মন্দির। পূর্ববর্ধমানের পাণ্ডুক গ্রামে রয়েছে এই বামা কালীরমন্দির।

সিঙ্গুরের প্রসিদ্ধ ডাকাত কালী ও বিশে ডাকাতের নাম অনেকেরই শোনা। ডাকাত বিশের নাম নীল বিদ্রোহের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে। কারণ, বহু নীলকর সাহেবদের খুন করে জ্বালিয়ে দিয়েছিল এই বিশু ডাকাত। আবার শোনা যায়, চালকেবাটির মোড়ল দেবীর স্বপ্ন পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় জঙ্গলের মধ্যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে কালী পুজোকে কেন্দ্র করে ডাকাতরাও পেয়েছিল আশ্রয়। ডাকাতি করতে যাওয়া ও ফেরার পথে কালী পুজো দিত ডাকাতরা।

বোলপুরের শান্তিনিকেতনের ভুবনডাঙ্গার মাঠের নাম অনেকেরই জানা।এক সময় বোলপুরের ভুবনডাঙ্গার মাঠ আর এই অঞ্চল শাসন করতো দুর্ধর্ষ ভুবন ডাকাত। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত| পড়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই অঞ্চলের ব্যাপক সংস্কার করেন এবং তারও পরে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন| ধীরে ধীরে প্রচারে আসে বোলপুর শান্তিনিকেতন আর আড়ালে চলে যায় ভুবন ডাকাতের গল্প|

যে জায়গাটিকে এখন আমরা রানাঘাট বলে জানি সেই অঞ্চলের ত্রাস ছিল রানা ডাকাত| এলাকায় রবিন হুড ইমেজ ছিলো তার| ব্যাপক লুটপাঠ চালাত এই রানা ডাকাত| বহুকাল ধরে সে নিজের প্রাধান্য বজায় রেখে রবিন হুড ইমেজ বজায় রেখেছিল তারপর ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় বিস্মৃতির অতলে| তবে নদিয়া জেলা অথবা রানাঘাটের ইতিহাসে তার কথা লেখা আছে|

এই কলকাতা এক কালে ছিল এক দুর্গম অনুন্নত গ্রাম্য অঞ্চল। তখন সেই কলকাতা শাসন করত একদল ডাকাত, দিনে দুপুরেও লোকে কেঁপে উঠতো তাদের নাম শুনলে| এমনই এক ডাকাত সর্দার ছিলো চিতে ডাকাত। তারই নামে আজকের চিৎপুরের নামকরণ হয়েছে|

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version