জলদস্যু কথাটি শোনামাত্র চোখের সামনে ফুটে ওঠে সমুদ্রে ভাসমান জাহাজে বর্বর এক নাবিকের চেহারা। যার আপাদমস্তক বিদঘুটে পোশাকে ঢাকা। সে তার দলবল নিয়ে সমুদ্রে বিস্তীর্ণ জলরাশির বুকে ঘুরে বেড়ায়। ওঁৎ পেতে থাকে লুটপাটের আশায়। সুযোগ পেলেই দলবল নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে জাহাজের সবাইকে কোতল করে, তারপর তাদের সমস্ত মালপত্র লুট করে পালিয়ে যায়। সেখান থেকে। হাজার বছর আগে কেবলমাত্র পুরুষরা নয় মহিলা জলদস্যুরাও সমুদ্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করতো। যদিও ২০ শতকের আগে পর্যন্ত তাদের সমুদ্রযাত্রা সম্পূর্ণভাবে ছিল নিষিদ্ধ। কারণ নাবিকরা বিশ্বাস করত, দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় জাহাজে মেয়েদের রাখলে জলদেবতারা ক্ষুব্ধ হতে পারেন। তাই অনেক মহিলা জলদস্যুরা সমুদ্রে ছদ্মবেশে থাকতো। মহিলা জলদস্যুদের মধ্যে অনেকেই ক্ষমতা এবং সাহসে পুরুষ জলদস্যুদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল যদিও তাদের নেপথ্যে শক্তি জোগাতো পুরুষরাই।

চিং শি ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত মহিলা জলদস্যুদের একজন। ৮০ হাজার জলদস্যু তার আঙুলের ইশারায় উঠতো-বসতো। প্রায় হাজার দুই যুদ্ধ জাহাজ ছিল তার আয়ত্ত্বে। সেগুলি তার নির্দেশ মতো সমুদ্রের বিভিন্ন জাহাজে লুটপাট চালাতো।  প্রথম জীবনে এই মহিলার বাস ছিল ক্যান্টন শহরের ভাসমান পতিতালয়ে। সুন্দরী হলেও গরীব ঘরের মেয়ে, অবস্থার চাপেই সম্ভবত শরীর বিক্রির পেশাকেই জীবিকার পথ হিসাবে বেছে নিয়েছিল। সেই আদিম পেশার হাত ধরেই তাঁর জায়গা হয় সমুদ্রের কাছাকাছি জলের উপর ভাসমান এক পতিতালয়ে। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় ও বিবাহ হয় চেং আইয়ের। সে ছিল দক্ষিণ চীন সাগরের এক ভয়ঙ্কর জলদস্যু। দু’জনে বিয়ে করে সংসার বাঁধে তারপর থেকে চিং শি তার স্বামীর সঙ্গে দুঃসাহসিক বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেয়। একটা সময় চেং আইয়ের আয়ত্ত্বে ছিল ১২০০টি জাহাজ আর ৭০ হাজার জলদস্যু। বিয়ের ৬ বছরের মাথায় ৪২ বছর বয়সে চেং আই মারা গেলে পরবর্তী উত্তরাধিকার হিসেবে দায়িত্ব পায় তার পালকপূত্র চেং পো পো সই।

 চিং শি  চেং পো পো সই-এর সম্পর্কে সৎ মা হলেও, তার প্রেমে পড়ে। ক্ষমতার লোভই এই সম্পর্ক তৈরি করেন চিং শি। পরবর্তীতে তাদের বিয়ে হয় এবং সে দস্যুরানী হয়ে  দ্বিতীয় স্বামীর সব দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও চতুর চিং শি ২য় স্বামী মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুরো দস্যুবাহিনীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে দস্যু জাহাজগুলির জন্য একটি কঠোর আইন তৈরি করে। তার নির্দেশ ছিলো, উপকূলীয় কোনো গ্রামবাসীদের থেকে লুটপাট করা যাবে না।   এ ছাড়াও জাহাজে অপহরণ করা নারী বা শিশুর সঙ্গে কোনো দস্যু যৌনসম্পর্কে লিপ্ত হতে পারবে না। এই কাজ করলে তার শিরচ্ছেদ করা হবে। যদিও পরবর্তীতে এ জাতীয় কাজের কারণে অনেক দস্যুকেই চিং শি মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শিরচ্ছেদ করে। রিচার্ড গ্লাসপুল নামে একজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী একসময় চিং শি-র জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়লে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। তিনি তার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, চিং শি ৮০ হাজার জলদস্যুকে একাই নিয়ন্ত্রণ করতো, প্রায় হাজারখানেক বড় জাহাজ এবং ৮০০টি ছোট জাহাজ এবং নৌকা ছিল তার আয়ত্ত্বে।

ম্যাকাও থেকে ক্যান্টন পর্যন্ত দক্ষিণ সমুদ্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল চিং শিহ-র৷ ওই বিস্তীর্ণ এলাকার সমুদ্রতীরের গ্রামগুলোকেও নিজের ছত্রছায়ায় নিয়ে এসেছিল সে। গ্রামের মানুষকে জলদস্যুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে বিনিময়ে কর নিত গ্রামবাসীদের থেকে৷ তাঁর কঠোর অনুশাসন, তুখোড় যুদ্ধনীতি, আর নির্মম শাস্তির জন্য দক্ষিণ সমুদ্রের ত্রাস হয়ে দেখা দিয়েছিল এই দস্যুরানি।ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ বলেন, লুঠতরাজের পাশাপাশি চিং শিহ আফিম চোরাচালানের ব্যবসা করত,  কারও মতে, জলদস্যুদের আক্রমণে সমুদ্রতীরের গ্রামগুলিতে সেসময় প্রায়ই যে লুটপাট, ডাকাতি, কর-আদায় চলত, সেই অরাজকতাই থামাতে চেয়েছিল সে। আর এই কাজে তার সহায়ক হয়েছিল প্রথম জীবনের অন্ধকার অভিজ্ঞতা। টানা ৩ বছর সমুদ্রে দাঁপিয়ে বেড়ানো এই মহিলা চীন সরকারের কাছে ধরা পড়ে। এরপর ক্ষমা প্রার্থনা করে অবসর গ্রহণ করে চিং শি।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version