সম্প্রতি Myer Capital নামের একটি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যাটফর্মের একটি সমীক্ষা চারপাশে একটু গুঞ্জন তুলেছে। সমীক্ষাটি চলে ৫২০০ জন শহুরে স্বাবলম্বী মহিলার মধ্যে যারা মুলতঃ মুম্বাই, দিল্লি, পুণে, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর শহরের বাসিন্দা। ওই সমীক্ষা জানাচ্ছে যে এঁদের মধ্যে অন্তত ৩১ শতাংশ পারিবারিক আর্থিক সিদ্ধান্ত সকলের সঙ্গে জড়িত নন। আর ৩৬.৪ শতাংশ মহিলা আদৌ কোনও বিনিয়োগ করেন না। সমীক্ষায় আরও জানা গেছে, মাত্র ২৭% মহিলা নিজের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিজে নেন। বাকিদের বৃহদংশের ক্ষেত্রে, বিনিয়োগ চলে স্বামী বা পরিবারের সিদ্ধান্তে।

এই সমীক্ষায় পুর্বভারতের মেয়েদের কথা নেই। পুর্বভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের কোনও সম্পুর্ণ ছবি সমীক্ষায় চোখে পড়েনি। যদিও গ্রামের মেয়েদের ক্ষমতায়নের তথ্যাদি গণপরিসরে মেলে প্রচুর। বিশেষত মাইক্রোফিনান্স (#MicroFinance) অথবা মেয়েদের সেলফ-হেল্প গ্রুপের কার্যকারিতা নিয়ে আলাপ-আলোচনায় সে তথ্য হামেশাই বিভিন্ন জায়গার প্রেক্ষিতে উঠে আসে। এমনকি সেই প্রেক্ষিতে মেয়েদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের ইন্ডেক্স মাপার জন্য বিবিধ মাপকাঠিও তৈরি হচ্ছে বইকি। যেমন চন্দন রায়, সুস্মিতা চ্যাটার্জী ও সঙ্গীতা দত্তগুপ্তের গবেষণাপত্রে সেলফ-হেল্পদলের (#SelfHelp) মেয়েদের জন্য তাঁরা স্বাস্থ্য, জ্ঞান আর অর্থনৈতিক কাজ তিনটির ভিত্তিতে এবং সেই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক গন্ডিতে স্বশাসনকে জুড়ে এক সুন্দর ব্যক্তিগত তথা দলগত ক্ষমতায়নের মাপকাঠি বানিয়েছেন।

কিন্তু শহর-মফঃস্বলের হাজারও মেয়েরা, যাঁরা দারিদ্র্য-দূরীকরণ সীমার বাইরে, তাদের কি অবস্থা? ধরেই নেওয়া হয় যে তাদের পেটে দু- অক্ষর বিদ্যা আছে, সামান্য হলেও হয় নিজের হাতে পুঁজি আছে নাহলে ধার পাওয়ার থিওরিটিক্যালি উপায় জানা আছে। এবং এই শ্রেনিসীমায় সচেতনতা আগের থেকে একটুখানি হলেও বেড়েছে – তাই ঠিক সেই আগের মত ছেলের জন্য ভাল স্কুল, ভাল খাবার, ভাল ডাক্তার আর মেয়ে হলেই হতচ্ছেদ্দা আর ততটা খোলাখুলি হওয়া ফ্যাশন না। তত্ত্বগতভাবে অন্তত এই শ্রেণিতে বাপের বাড়িতে কুমারী মেয়েদের পারিবারিক সম্পদের উপর সমানাধিকার ব্যাপারটা বেশ মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি তাতে পুর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হল? আজও বিয়ে একটা গুরুতর সামাজিক ক্রিয়া, এবং মেয়েদের জীবনের বড় অংশই কাটে যে বাড়িতে, সেই শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক সম্পদে বিবাহিত মেয়েদের কতটা অধিকার থাকে?

শ্বশুরের সম্পদ না হয় ছেড়েই দিলাম, স্বামীর আয়ে তৈরি সম্পদ তার একার নামে হলে, তিনি সেই সম্পদ নিয়ে যা খুশি করতে পারেন, দান-বিক্রি যা খুশি, স্ত্রীর মতামতের তোয়াক্কা না করেই। অথচ পারিবারিক সম্পদ, বাবা-স্বামী-শ্বশুর যারই হোক বা এমনকি নিজেরও, নিজের ইচ্ছায় কেনা-বেচার স্বাধীনতা কটা মেয়ের থাকে? এমনকি যাঁরা নিজেরা চাকরি করেন, সেই মেয়েরাও এই অধিকার পান কি? কেনা-বেচা অনেক পরের কথা, স্থাবর সম্পত্তির দলিলে কতজন মেয়ের নাম ওঠে? সরকারি প্রকল্পের বাধ্যতামূলক মহিলা-নাম-অন্তর্ভুক্তির সুযোগও তো এঁদের বেশিরভাগ সময়ই অধরা থাকে। কজন মেয়ে পারিবারিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বাবদে মুখ খোলার জায়গা পান? সব থেকে বড় কথা নিম্ন বা মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়েরা গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট হয়ে ওঠেন, এমনকি মা-মাসিদের দেখে দেখে মুষ্টি-সঞ্চয়েও ঘোর এক্সপার্ট হন, কিন্তু ক্ষুদ্রসঞ্চয়কে সম্পদে পরিণত করার মতন প্রাথমিক অর্থনৈতিক জ্ঞান তাঁদের কতটা থাকে? অথচ এই সব প্রশ্নগুলোই কিন্ত ক্ষমতায়ন মাপার এক একটি ধাপ।          

এও কিন্তু জানি যে সম্পদের মালিকানা এক অতি বিতর্কিত, অতীব জটিল বিষয়। এতোই ব্যক্তিস্বার্থ-বনাম-পারিবারিক স্বার্থের টানাপোড়েনে ভরা আর সেই সঙ্গে এর অভিঘাত এতোই সুদূর-প্রসারী ও এতোই নির্দিষ্ট প্রেক্ষিত-নির্ভর যে বদল ভাবতে গেলে ভাল’র চেয়ে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অথচ এই মেয়েদেরও ইন্সটিটিউশন-ভীতিও প্রবল। একটু বয়স্কদের ডিজিট্যাল জ্ঞানেরও খুব অভাব। বেলাশেষে সিনেমায় যাই দেখাক, অভ্যাসের দাসত্বও প্রবল। অধিকার-সচেতনতার থেকে গতানুগতিকতায় আস্থা রেখে ভবিতব্য মানার প্রবণতা উৎকট রকমের প্রকট। নিজেদের অবস্থানের সীমাবন্ধতার বোধের কারণে আত্মবিশ্বাসেরও তুমুল অভাব। তাই মনে হয় সামাজিক অবস্থানে বৈষম্যের ধারণা টিকিয়ে রেখে, মেয়েদের চাকরিটুকু যদিও বা দেওয়া যায়, সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ঘটানো সম্ভব কি আদৌ? অর্থনীতি কি এতোটাই বিযুক্ত বাদবাকী সামাজিক পরিবেশের থেকে?

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version