কলকাতা ব্যুরো: শুরু করেছিলেন জীবনের শেষ গান, ”হাম, রহে ইয়া না রহে কাল”। মোহিত হয়ে সেই গান শুনছিলেন দর্শকরা। কিন্তু এই গানই যে তাঁর শেষ গান হয়ে যাবে তখন কেই বা জানতেন! লাইভ কনসার্ট চলাকালীন যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছিল সুর-তাল-লয়। তবুও হাসিমুখে স্টেজ সেরে হোটেলে ফেরার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন জনপ্রিয় গায়ক কেকে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছন্দপতন। হাসপাতালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলে জানিয়ে দেওয়া হয় দেরি হয়ে গিয়েছে। কেকে আর নেই। শিল্পীর জীবন কী এরকমই! এতটাই ক্ষণস্থায়ী? কে কে-এর মৃত্যু যেন চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়ে গেলো।
কেকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই শহর কলকাতা অদ্ভুত এক ঘোরে ডুবে। সেই ঘোর কাটিয়ে বেরিয়ে আসা যে অসম্ভব! সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর চর্চা। চিকিৎসকমহলেও আলোচনা। ইতিমধ্যেই অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা জারি হয়েছে। যাঁরা জনপ্রিয় শিল্পীর লাইভ অনুষ্ঠান দেখতে গিয়েছিলেন, তাঁরাও এই ঘটনায় স্তম্ভিত।
ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামে মোট ২০টি গান ছিল তাঁর তালিকায়। শেষ পারফরম্যান্সে যে গানগুলি কেকে গেয়েছেন তা দেখুন এক নজরে…
- তু আশিকি হ্যায়
- ক্যায়া মুঝে প্যায়ার হ্যায়
- দিল ইবাদত
- মেরে বিনা
- লবো কো লবো সে
- তুহি মেরি শব হ্যায়
- আঁখো মে তেরি আজব সি
- আভি আভি
- MP3
- তু জো মিলা
- ইয়ারো
- খুদা জানে
- জরা সি দিল মে দে জাগা তু
- আশায়ে
- ডন
- তুনে মারি এন্ট্রিয়া
- দেশি বয়েজ
- ডিস্কো
- কোই কহে কহতা রহে
- প্যায়ার কে পল

এই আকস্মিক মৃত্যুর পিছনের কারণ কী? নজরুল মঞ্চের এক কর্মীর কথায় সামনে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাঁর কথায়, তিনি ১২ বছর নজরুল মঞ্চে কর্মরত। কিন্তু মঙ্গলবারের মত এদৃশ্য তিনি নজরুল মঞ্চে আগে দেখেননি। নজরুল মঞ্চের ওই কর্মীর অভিযোগ, আসন সংখ্যার থেকে অনেক বেশি ভিতরে ঢুকে যায়। প্রবল ভিড়ের জন্য বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয়। যার প্রমাণ প্রেক্ষাগৃহের পিছন দিক থেকে ছোঁড়া বোতল। যা কিনা এদিক ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে অনুষ্ঠান শেষের বহু ঘণ্টা পরেও।
নজরুল মঞ্চের ওই কর্মী বলেন, কেকে মঞ্চে ওঠেন সন্ধ্যা ৭টা নাগাদ। তারপর একটার পর একটা গান গেয়ে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে ব্যাকস্টেজে গিয়ে ঘাম মুছে এসে আবার গান ধরছিলেন। ৮টা ৪০ নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হয়। প্রথম থেকেই খুব ভিড় হচ্ছিল। যেখানে আসনসংখ্যা ছিল ২৪৮২, সেখানে ভিড় হয়েছিল প্রায় ৮০০০। ৭টা দরজার ৫টাই খোলা ছিল। মঞ্চের দুদিকেও লোক দাঁড়িয়ে যায়। এসি বন্ধ ছিল না। কিন্তু অত ভিড়ে কাজ করছিল না এসি। দরজা খোলা থাকায়, হাওয়া বেরিয়ে যাচ্ছিল।
অন্যদিকে কেকে-এর শেষ কনসার্টের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, আয়োজনেই গলদ ছিল। সেই প্রত্যক্ষদর্শীর মতে, চূড়ান্ত অব্যবস্থা ছিল অনুষ্ঠানের আয়োজকদের তরফে। এমনকী, অনুষ্ঠানে ঢোকার আগে ইট, পাথর, কাঁচ ছোঁড়া হয়। আয়োজকদের সঙ্গে হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়ে কনসার্ট দেখতে আসা জনতা। এক কলেজ পড়ুয়া দেখতে গিয়েছিলেন কেকের কনসার্ট। তিনি জানিয়েছেন, অনেকের কাছেই পাস ছিল। কেউ কেউ বিনামূল্যেও পাস পেয়েছিলেন। আবার অনেকেই পাঁচ হাজার টাকা দিয়েও অনুষ্ঠানের টিকিট কিনেছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর আগে পাস ছাড়াই অনেকে নজরুল মঞ্চে ঢুকে গিয়েছিলেন। ফলে আয়োজকদের সঙ্গে শুরু হয়ে যায় ধাক্কাধাক্কি।
সেই ছাত্রী আরও জানিয়েছেন, ধাক্কাধাক্কির ফলে অনেকেই আহত হন। এমনকী, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের মাধ্যমে ভিড় ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছিলেন আয়োজকরা। পাস থাকা সত্ত্বেও হলে ঢুকতে দিচ্ছিলেন না আয়োজক ভলান্টিয়াররা। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে পড়েন সকলেই। তখনই আয়োজকদের দিকে পাথর ছোঁড়া হয়। পালটা অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র চালায় আয়োজকরা। সেই গ্যাসের ফলে অনেকেই অসুস্থ বোধ করেন। জায়গা থাকা সত্ত্বেও আয়োজকরা নজরুল মঞ্চে ঢুকতে দেয়নি বলেই অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সেই ছাত্রীর।
অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য সেরকম বিপত্তি ঘটেনি। কিন্তু প্রচণ্ড ভিড়ের ফলে ক্রমশ গরম বাড়তে থাকে হলের ভিতর। সেই ছাত্রী জানিয়েছেন, এসি চালানো হয়েছিল হয়তো। কিন্তু তাতেও প্রচণ্ড গরম লাগছিল সকলের। তিনি বলেন, কেকে বারবার বলছিলেন, পিছন দিকের আলো নিভিয়ে দিতে কারণ আলোর ফলে বেশি গরম লাগছিল। কিন্তু বারবার বলা সত্ত্বেও আলো নেভানো হয়নি।
অনুষ্ঠান চলাকালীন কি অসুস্থ বোধ করছিলেন কেকে? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, প্রচণ্ড গরমের কারণেই ভীষণ ঘামছিলেন কেকে। বারবার জল খাচ্ছিলেন। অসুস্থ বোধ করলেও মঞ্চে কেকে-কে দেখে মনেই হয়নি তিনি শারীরিক দিক থেকে সুস্থ বোধ করছেন না।
এই পরিস্থিতিতে নজরুল মঞ্চে বিশৃঙ্খলার অভিযোগ উঠেছে। মাত্রাতিরিক্ত ভিড়ের কারণে দমবন্ধকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে, তদন্তে নেমছে কেএমডিএ। তবে দুর্ঘটনার পর কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানান, ক্যাপাসিটির তুলনায় বেশি লোক হলে এসি পুরো এলাকাকে ঠাণ্ডা করতে পারে না। তবে মঞ্চে কোনও প্রভাব পড়েনি। তরুণ-তরুণীদের উচ্ছাস কন্ট্রোল করা সম্ভব নয়।
পাশাপাশি মেয়র আরও জানিয়েছেন, আগামীদিন কলেজের অনুষ্ঠানে নজরুল মঞ্চ ভাড়া দেওয়ার পক্ষে নন অফিসাররা। কিন্তু, আমি এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। আর এসি আমাদের ঠিক ছিল। তবে হলের ক্যাপাসিটি যা ছিলো তার চেয়ে বেশি লোক হলে একটু সমস্যা হবেই। একটা লিমিটেশন আছে যেটা ২৭০০ ক্যাপাসিটি সেখানে ৭০০০ হলে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের একটা সমস্যা হয়। পাঁচিল টপকে গতকাল ছেলেমেয়েরা ভিতরে প্রবেশ করেছে। কন্ট্রোল করা যায়নি মানুষের জন্য। তার মধ্যে পুলিশ লাঠিচার্জ ও করতে পারে না। কে কে-এর মৃত্যুটা হওয়ার ছিল এটা নিয়ে কোন কন্ট্রোভার্সি করে লাভ নেই। আমি এখন আছি এক মিনিট পর নাই থাকতে পারি।
তবে সঙ্গীতশিল্পী কেকের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। টুইটে তিনি জানিয়েছেন, কেকে-এর মৃত্যুর মর্মান্তিক খবর পেয়েছি। শেষবার কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ (কেকে) নজরুল মঞ্চে অনুষ্ঠান করেছেন। মাত্র ৫৩ বছর বয়সি এই সঙ্গীতশিল্পীহর মৃত্যুর খবর পেয়ে অত্যন্ত খারাপ লাগছে। তাঁর অনুরাগী ও পরিবারের প্রতি আমার গভীর সমবেদনা।
মঙ্গলবারের কনসার্টে অনেকগুলি গান গেয়েছিলেন কেকে। কিন্তু এমন সুরেলা পারফরম্যান্সের পরে সবকিছুই কেমন যেন বেসুরো হয়ে গেলো। ভেঙে পড়েছেন কেকে অনুরাগীরা। গোটা দেশ স্তম্ভিত। সোশ্যাল মিডিয়া আবেগে ভাসছে। ভক্তদের কাছে কেকে ঈশ্বর। কিন্তু ঈশ্বরের কি সত্যিই মৃত্যু হয়? বলা ভালো শিল্পীদের মৃত্যু হয় না। ভক্তদের হৃদয়ে তাঁরা বেঁচে থাকেন চিরকাল। তিনি হয়তো থাকবেন না কিন্তু থেকে যাবে কলকাতার বুকে নজরুল মঞ্চে কাটানো ওই বিশেষ মুহূর্তরা।