গেল শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে বলিউডি ছবি ‘দিওয়ার’-এর একটি সংলাপ সিনেমা হল কাঁপিয়ে দিয়েছিল। গোটা ছবিতে অমিতাভ বচ্চন রাজ করলেও  শশী কাপুর যখন বলেন, ‘মেরে পাস মা হ্যায়’! তখন কেবলমাত্র প্রেক্ষাগৃহ নয় মাতৃবন্দনায় নন্দিত হয় আসমুদ্র হিমাচল। যেভাবে শশী কাপুর সেই মুহুর্তকে তার অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলেন তাতে বুঝিয়ে দেন ওই মাতৃ বন্দনা কেবল সংলাপ নয় বিশ্বাসী উচ্চারণ। 

কিন্তু অবাক হতে হয়; যখন জানা যায় যে এমন এক মাতৃভক্ত সন্তানকে তাঁর গর্ভধারিনী জন্মের আগেই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, পদ্মভূষণ থেকে শুরু করে ফিল্মফেয়ার, লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড সবকিছুই রয়েছে যার অভিনয় জীবনের ঝুলিতে সেই শশী কাপুরকে, যদিও শশী নয়; তাঁর আসল নাম বলবীর রাজ কাপুর, তবে শশী নামেই তাঁর পরিচিতি তাঁর মা জন্মের আগেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন।

১৯৯৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে তার জীবনের বেশকিছু অজানা কথা প্রকাশ্যে এনেছিলেন শশী কাপুর। জানিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তার মা রামসারণী মেহরা কাপুরের অযাচিত সন্তান। জন্মের আগেই শশীকে শেষ করে দিতে অর্থাৎ মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন তাঁর মা। সেই সাক্ষাৎকারে শশী কাপুর বলেছিলেন, ‘আমার মা আমায় ফ্লুকি বলে ডাকতেন। কারণ, আমাকে এই পৃথিবীতে আনার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না তাঁর।’ শশী কাপুর এও জানান, ‘আমার আগে আমার মায়ের চার পুত্র সন্তান ছিল। রাজ কাপুর ও শাম্মী কাপুরের মাঝে দুই ভাই ছিল যারা মারা যান। তাই ১৯৩৩ সালে আমার বাবা-মা-র কন্যা সন্তান ঊর্মিলা আসার পর যথেষ্ট খুশি ছিলেন তাঁরা।’

শশী জানিয়েছিলেন, ‘এর ৫ বছর পর ফের সন্তানসম্ভবা হওয়ার খবরে একেবারেই খুশি হতে পারেননি আমার মা। তখনকার দিনে গর্ভপাত করার সুযোগ সেভাবে ছিল না। তাই সাইকেল চালিয়ে, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে, কুইনাইন খেয়ে আমার মা আমায় নষ্ট করে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাতেও তার গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে যায় নি। এটা খুব আশ্চর্যের হলেও সত্যি’।’ শশী এসব কথা কীভাবে কার কাছ থেকে জেনেছিলেন তার উল্লেখ করেননি। তবে শশী জানিয়েছিলেন যে ছেলেবেলায় খুব মন খারাপ করে তিনি একবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন। 

শশী কাপুরের কথা অনুযায়ী, তার ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফল খুব খারাপ হয়েছিল। সেই কারণে সেই সময় তিনি ভীষণভাবে মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। বিষয়টা তার বাবার নজরে আসে। তারপর তাকে মাথেরানে ছুটি কাটাতে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর দেওলালি এলাকার বার্নেস স্কুলে তাকে রেখে আসেন ভাই শাম্মী কাপুর। কিন্তু সেখানেও শশী কাপুর খুব একা বোধ করতেন। একদিন তিনি সেই স্কুল থেকে বাড়িতে চিঠি লিখলেন যে সেখানকার খাবার একদম ভাল নয়। কিন্তু সেখানেও শশী কাপুর খুব একা বোধ করতেন। একদিন তিনি সেই স্কুল থেকে বাড়িতে চিঠি লিখলেন যে সেখানকার খাবার একদম ভাল নয়। চিঠিতে শশী আরও লিখেছিলেন যে তিনি প্রায় দিন না খেয়ে থাকেন। তাকে যেন তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যদি তা না করা হয় তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। পরে তার মা-ই শাম্মী কাপুরকে বলেন ভাইকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে।

শশী জন্মেছিলেন কলকাতায় ১৯৩৮ সালের ১৮ মার্চ। যে বাড়িতে তিনি জন্মেছিলেন সেই বাড়িটি আজও অক্ষত। তার ঠিকানা, ১১৪ নং হাজরা রোড। তাঁর বাবা পৃথ্বিরাজ কাপুর তখন কাজ করেতেন কলকাতার নিউ থিয়েটার্স-এ। সেই সূত্রেই তিনি এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এই কলকাতাতেই থিয়েটারে কাজ করে শশী নিজেকে ডুবিয়ে নিয়েছিলেন অভিনয়ের আলোয়। পাঁচের দশকে এক অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে পড়েছিলেন। আসলে তখন তিনি অভিনয়ের রাগ-উৎস সন্ধানে ছুঁটে বেড়াচ্ছেন। সেই সময়ে কলকাতায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ব্রিটিশ অভিনেত্রী জেনিফার কেন্ডালের সঙ্গে। ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’ নাট্য দল নিয়ে জিওফ্রে কেন্ডাল তখন কলকাতায়। এই দলেই লিড-অ্যাক্ট্রেস ছিলেন জিওফ্রে-র বড় কন্যা জেনিফার। শশী কাপুরও নাম লেখালেন ‘শেক্সপিয়ারিয়ানা’-য়। জেনিফারের সঙ্গে শশীর ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ শুরু হতে দেরি হয়নি। বয়সে বড় হলেও জেনিফার তখন হৃদয় দিয়ে ফেলেছিলেন বিদেশি লুকের শশী কাপুরকে। স্টেজ অভিনয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎও বাধা হতে পারেনি এই প্রেমে। শশী যখনই কলকাতায় এসেছেন বারবার স্মরণ করেছিলেন তাঁর ও জেনিফারের সেই প্রেমের দিনগুলিকে।   

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version