ষষ্ঠ পর্ব

বেশ হৈ-হুল্লোড় করে চারটা দিন কাটিয়ে দিলাম। আগামীকাল নাকি দুপুরের মধ্যে আমরা পোর্টব্লেয়ার ছুঁয়ে ফেলবো। প্রতিদিনই একা হলে একটা দুঃশ্চিন্তা আমাকে ঘিরে ধরতো,আন্দামানে থাকব কোথায়? পকেট তো স্বাস্থ্যবান নয় বরং বেশ রুগ্ন। ওখানে গিয়ে খাওয়া আছে, ঘোরাঘুরি আছে, সর্বোপরি কলকাতা ফেরা আছে। হোটেলের ভাড়া কিরকম পড়বে তাও অজানা। তাই একটা শঙ্কা সবসময়ই ঘিরে রাখতো আমাকে। শঙ্কাটা কয়েকগুণ বেড়ে এবার আতঙ্কে পরিণত হলো।

কমল দা এবং কল্যানীর বি এডের ছাত্রেরা আসার আগেই থাকার জন্য ইয়ুথ হোস্টেল বুক করে এসেছেন, ফেরার টিকিটও ওদের হাতে। কিন্তু আমার হাত এক্কেবারেই খালি। আর হবে নাই বা কেন? ওরা তো কেউ কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে আন্দামান চলে আসেনি, একা একাও আসেনি। কিন্তু যতই এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে অহংকার করিনা কেন, শঙ্কা আমাকে ছাড়ে নি। যদিও ওঁরা সবাই এমনকি ওঁদের কেবিনবাসী ম্যাডাম পর্যন্ত আশ্বাস দিয়েছেন, ‘একটা দিন কোথাও কাটিয়ে দাও, তারপর আমরা ঠিক ইয়ুথ হোস্টেলেই ব্যবস্থা করে ফেলবো’। এই আশ্বাসে কিন্তু আমার মনের শঙ্কা দূর হয়নি।

আমার বিয়ার খাওয়া নতুন জাহাজী বন্ধু উঠবে তার দিদির কাছে, আমার সমস্যা জেনেও সে চুপ। নিজের থেকে তাকে কিছু বলতে পারছি না। আবার ভাবছি, চিন্তা করেই বা কি হবে। যখনকার ভাবনা তখন ভাবলেই চলবে।

সকাল থেকেই প্রায় সবার সাজো সাজো রব, আমরা ডেকে জড় হয়েছি, একটু পরেই আমাদের জাহাজ এম ভি হর্ষবর্ধন ডাঙা স্পর্শ্ব করবে, আমরা নামবো আন্দামানে।

শুধু ভ্রমণের জন্য আসা যাত্রীর সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। যারা এসেছেন তাদের অনেকেই ব্যবসায়ী, তারা নিয়মিত আসা যাওয়া করেন, অনেকেরই আত্মীয়স্বজন এখানে কাজ করেন, তাঁরা এসেছেন রথদেখা ও কলা বেচা দুটিই সেরে নিতে। কেউকেউ ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরে আসছেন। আর একেবারে শ্রমিকশ্রেনীর কিছু লোক এসেছেন ঠিকাদারের হয়ে কাজ করতে। এছাড়া রয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় কিছু নিম্নবর্গের মানুষ। আমি অবশ্য শুধু আমাদের ব্যাঙ্ক ক্লাসটার কথাই জানি, কেবিনের যাত্রীরা কারা? সে খবর আমার কাছে নেই।

একসময় হর্ষবর্ধন পোর্টব্লেয়ারের ‘চ্যাথম’ ডকে নোঙর করলো। হৈহল্লা, হুড়োহুড়ি, ডেকের উপর শয়ে শয়ে লোক,নিচের ডকেও লোকে লোকারণ্য। আত্মীয়স্বজন, প্রিয়জনদের দেখে অনেকেই হাত নাড়ছেন, আমি শুধু একা। জাহাজে আমার পরিচিত জনেরাও দেখা হবে বলে মিষ্টি হেসে সবাই নেমে গেলন একে একে। একবুক কান্না নিয়ে সেই যমুনা বালার ছবি বুকে চেপে আমিও নেমে এলাম জাহাজ থেকে।

কি করবো বুঝতে পারছি না। শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এলাম পোর্টব্লেয়ারের একমাত্র বাংলা মাধ্যম স্কুল ‘রবীন্দ্র বাংলা বিদ্যালয়ে’। মনের আশা এখানে তো সবাই বাঙলা ভাষী, নিশ্চয়ই ওদের কাছে পেয়ে যাবো কোন সমাধান। ঠিক তাই সমাধানই শুধু পেলাম না, পেলাম বাড়তি অনেক কিছু।

প্রবাসী বাঙালী বলেই হয়তো এতটা দরদী ব্যবহার পেলাম ওঁদের কাছে। গেটের দারোয়ানই পৌঁছে দিল কমনরুমে। সেখানে  গিয়ে পরিচয় দিলাম। সবিস্তারে জানালাম, আমি কলকাতা থেকে আজকের জাহাজেই এসেছি। সঙ্গী নেই কেউ, পকেটের স্বাস্থ্যও ভালো নয়,কম পয়সায় থাকা-খাওয়ার একটা জায়গা জোগাড় করতে হবে, সে বিষয়ে আপনাদের পরামর্শ চাই। আমার বয়স এবং আমি একা, এটাই বোধহয় সবাই কে কৌতুহলী করে তুললো। ওঁরা প্রথমেই আমাকে চা কেক দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। প্রায় সবাই মিলেই আশ্বস্ত করলেন চিন্তার কিছু নেই একটা কোনও ব্যবস্থা হয়ে যাবে।নিজেরাই আলোচনা করছিলেন ‘ইয়ুথ হোস্টেল’ না ‘পি এন টি’র অতিথিশালা? আমার ইচ্ছা ইয়ুথ হোস্টেল কারণ সেখানে উঠেছে কল্যাণীর ওই বি এড গ্রুপটা, জাহাজে আসার সময় আমি যাদের ঘরের লোক হয়ে গিয়েছি। ওঁরা বরাভয় দিলেন। ইতিমধ্যে টুকটাক আলাপসালাপের মধ্যে এক মাষ্টার মশাই, সম্ভবত কোনও ক্লাশ শেষ করে হাতে চক-ডাষ্টার নিয়ে ঢুকলেন, তিনি একটু বেশি কৌতুহলী হয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চাইলেন আমার সমস্ত কিছু। শেষ অব্দি জানা গেল আমার বাড়ি পাঁশকুড়ার আগের স্টেশন ভোগপুরে ওনার শ্বশুর বাড়ি। তবে আর কি? স্কুলের সবাই কে জানিয়ে দিলেন আমার ব্যবস্থা উনিই করবেন। আমিও মোটামুটি দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলাম।

পরের ঘটনা আমি কল্পনাতেও আনতে পারিনি। তখন ফোনের যুগ নয় দু’জন ছাত্রের সঙ্গে একটা চিঠি লিখে মাষ্টার মশাই আমাকে পাঠিয়ে দিলেন নিজের বাসায়। ওনার নির্দেশ মতো সেখানে আমি স্নান খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নিলাম। বিকেলের পরে পরেই একে একে এসে পড়লেন, উনি, ওনার স্ত্রী, দুই ছেলে মেয়ে। (ভদ্রলোক ও ওনার স্ত্রী দুজনের নাম মনে আছে, এক বিশেষ কারণে এখানে তার উল্লেখ করলাম না) ওনার স্ত্রীও অন্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ছেলেমেয়ে দু’জনেই স্কুল ছাত্র। ভদ্রমহিলাও ভীষণ আন্তরিক, একেবারে দিদির মতো। জানিয়েও দিলেন পাঁশকুড়া একরকম আমার বাপের বাড়ি, শুধু তাই নয় কথায় কথায় বেরিয়ে পড়লো পাঁশকুড়া কলেজে উনি ছিলেন আমার দিদির চেয়ে একবছরের ছোট, দুজনেই বাংলা অনার্সের ছাত্রী। ব্যস, ভদ্রমহিলা সাফ জানিয়ে দিলেন বাইরে কোথাও থাকা যাবেনা, আমাকে তাঁর আশ্রয়েই থাকতে হবে। কিন্তু আমি তো দিদির বাড়ি আসিনি আমি এসেছি বেড়াতে, তার কি হবে?

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version