চতুর্থ পর্ব

রাজা ব্যানার্জি | ছবি: ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলি ও রুদ্ররাজ দাষ

পরদিন সকালে বেরিয়ে দুপুরের মধ্যেই গৌরিবাস পেরিয়ে পৌঁছনো গেল কাইয়াকাট্টা গ্রামে। প্রবল ঠান্ডায় রাস্তার জল, ঝর্নাগুলো জমে বরফ হয়ে গিয়েছে। রাস্তাতেও থেকে থেকে জমে রয়েছে বরফ। চোখে পড়লো, একটা চমরি গাই। এসেছে জল পানের আশায়। দেখলাম, বাঁচার তাগিদে শুধু মানুষই নয়, এই পৃথিবীর সমস্ত জীবজন্তুই ঠিক তার পথ খুঁজে নেয়। যেখানে জল খেতে এসেছিলো সে, সেটি তখন বরফে ঢাকা। বাঁকানো দুখানি শিঙ দিয়ে গুতিয়ে প্রথমে সে ভাঙলো ওপরে জমে থাকা বরফের আস্তরণ। তারপর পান করতে শুরু করলো জল। বিকেল পাঁচটার মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম কালিপোখরি। আজ রাতে সেটাই আমাদের ঠিকানা।পোখরি মানে জলাশয়। কালিপোখরি মানে যে জলাশয়ের জল কালো। খানিক বিশ্রাম নিলাম কালিপোখরির ধারে। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে মন ভরে গেলো।


রাতের আশ্রয় নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হলো না আমাদের। সে দায়িত্ব নিয়েছে থাপা ই। কালিপোখরি তে তার নিজের দিদি আর জামাইবাবু হোম স্টে চালান। গিয়ে উঠলাম সেখানেই। বাইরে বইছে কনকনে বাতাস। তাপমাত্রা মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
হাঁটার ধকলে আর প্রবল ঠান্ডায় আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সন্ধাতেই বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে। আমি গিয়ে উঁকি দিলাম কাঠের রান্নাঘরে। দেখলাম, আদা, পেঁয়াজ, আর রসুন আলাদা আলাদা করে বেটে পরিষ্কার সুতির কাপড়ে ছেঁকে তা কাচের জার এ ভরে রাখছেন মালকিন থাপার দিদি। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এভাবেই ওরা কয়েক মাস সংরক্ষণ করে রসগুলি। তাতেই চলে রান্না। নজরে এলো, বেশ কয়েক কেজি ওজনের এক তাল মাংস ঝুলছে। কিসের মাংস ওটা ? চমরি গাই? জিজ্ঞাসা করেই খানিক বেকুব বনে গেলাম। হা হা করে উঠলেন মহিলা। বললেন, চমরি গাই আমরা খাইনা। ও তো দুধ দেয়। এটা পুরুষ ইয়াকের মাংস। ইয়াক! শুনেই মনটা চাঙ্গা হয়ে গেল। জানতে চাইলাম, রান্না করবেন? দিদি পাল্টা বললেন, খাবে তোমরা ? আমি তো এক কথায় রাজি। তবু মনে হলো, বাকিদের মতটাও একবার জেনে নেওয়া দরকার। প্রথমে কারো কারো মধ্যে একটা ইতস্তত ভাব ছিলো বটে, তবে মোটের ওপর সবাই রাজি হলো। ফিরে গিয়ে পাঁচ-ছয় প্লেটের অর্ডার দিয়ে দিলাম।


রাম না পেয়ে গতকাল নাহয় ছাং খেয়ে কাটিয়েছিলাম। কিন্তু আজকের কি ব্যবস্থা হবে! মুশকিল আসান সেই গাইডই। ওই জানালো, ইধার থোম্বা মিলতা হ্যায়। বহুত আচ্ছা চিজ হ্যায়, সাব। বললাম, বেশ! দেখা যাক। দেখলাম, কাঠের একটি পাত্রে যার নিচের দিকে ছোটো ছোটো কিছু ছিদ্র আছে তাতে ঢালা হলো বিশেষ পদ্ধতিতে পচানো যব। নিচে রাখা হলো আরো একটি কাঠের পাত্র। তার একদিকে রয়েছে চোঙের মতো একটি বাঁশের স্ট্র। ওপরের পাত্রটিতে আস্তে আস্তে ঢালা হচ্ছে গরম জল। আর তাতেই পচানো যবগুলো ফুলে তা থেকে চুইয়ে চুইয়ে রস পড়ছে নিচের পাত্রটিতে। এভাবে তা তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ৪৫ মিনিট। দিদি বললেন, ও বনতা রহেগা, আপ ধীরে ধীরে পী তে যাইয়ে।
ততক্ষনে সেখানেই জমে গিয়েছে আমাদের আড্ডা। তৈরি হয়ে গিয়েছে ইয়াকের মাংসও। আগুনের মতো গরম, গাঢ় লাল তার রঙ। একখানা মুখে দিয়ে দেখলাম, বোনলেস সে মাংস তুলতুলে নরম আর রান্নাও হয়েছে অপূর্ব। মনটা খানিক খুঁতখুঁত করছিল অভিষেকের জন্য। নাদুস নুদুস চেহারার জন্য আমরা অবশ্য ওকে মোটা বলেই ডাকি। ঠান্ডায় কাবু হয়ে ও সেই যে বিছানায় সেটেছে , এখনো ওঠেনি।


প্লেটে খানিক মাংস তুলে নিয়ে গেলাম ঘরে। রান্নাঘরের পর রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় আমাদের ঘরে। বাইরে বেরোতেই যেন ছোবল মারলো ঠান্ডা। ঘরে গিয়ে দেখি, ও তখন কম্বলের তলায় আধো ঘুমে। ওর মুখে তুলে দিলাম এক টুকরো মাংস। খেয়েই ও প্রায় সোজা হয়ে বসলো। বললাম, আর নয়। আরো খেতে গেলে কম্বল থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে যেতে হবে। নয়তো ইয়াকের মাংস বাঁচিয়ে রাখার গ্যারান্টি দিতে পারছিনা।
ইয়াকের স্বাদে মজেই খানিক ব্যাজার মুখে হলেও ও হাজির হলো আড্ডায়। এবার যেন ষোলো কলা পূর্ণ হলো। ইয়াকের মাংস আর থোম্বার সঙ্গে চললো আড্ডা। কিভাবে যে সময়টা কেটে গেলো, মালুমই হলো না। কিন্তু রাত গড়াচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠান্ডার প্রকোপও। রাতে রুটি, আলুর তরকারি আর অমলেট খেয়ে চললাম ঘরের দিকে। সকালে ফের বেরোতে হবে। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম, থোম্বা আর ইয়াকের যুগলবন্দীতে ঠান্ডা অনেকটাই বশ মেনেছে।

চলবে….

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version