
প্রথম পরিচয়
তখন উনি কংগ্রেসের থেকে রাজ্যসভার সদস্য। আমি সেদিন বোলপুরের মহামায়া হোটেলে বসে ছিলাম। সঙ্গে ছিলেন কুমুদ রঞ্জন সেনগুপ্ত। সেকালের বীরভূমের বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা।
হঠাৎ কুমুদদা বললেন, প্রণব দা আসছে। তোমার সঙ্গে আমি পরিচয় করাবো। কিছু কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রণব দা। এলেন গাড়িতে বসে রয়েছেন স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে পাইপ খাচ্ছেন। প্রণবদার সঙ্গে আমার আলাপ করালেন দৈনিক বসুমতি সংবাদদাতা হিসেবে। বীরভূমের সাংবাদিক আমি রবীন্দ্রনাথের উপর আমার লেখার কথা প্রণব বাবুকে বললেন কুমুদদা। মিনিটদশেক বসে ছিলেন গাড়িতেই। তার মধ্যে নেমে এসে আলাপ করতে চাইলেন। উনার ভদ্রতাবোধ আমাকে অবাক করল। ঐটুকু সময়ের মধ্যে আমি বীরভূমের শিল্প সম্পর্কে ওনাকে কিছু তথ্য দিলাম। আমোদপুর সুগার মিল, কটন মিল পাথর শিল্পের মতো কিছু বিষয় ওনাকে বললাম। উনি সবটা শুনলেন।
দিল্লিতে পাঠানো পেপার কাটিং দেখেও ব্যবস্থা
এরপরে তিনি যখন এলেন, তখন আর সাংসদ নন, তখন তিনি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী। এর কিছুদিন আগে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম বিধান রায়ের স্বপ্ন রাজনগর ফার্ম নিয়ে। সেই ফার্মের উন্নতি হবে কিনা সেটা ই আমার বিষয় ছিল। লেখাটা কাটিং দিয়ে আমি প্রণব বাবুর দিল্লি ঠিকানায় পোস্ট করেছিলাম।
তিনি এলেন বোলপুরে। মাড়োয়ারি ধর্মশালায় কংগ্রেসের মিটিং। প্রণব বাবুর সঙ্গে এলেন ফুলরেনু গুহ আর নিত্যানন্দ সরকার। সেই সময় খুব গন্ডগোল, দুপক্ষের মধ্যে হলো হাতাহাতি হলো।
ওখান থেকে উনার যাওয়ার কথা মিরটির বাড়িতে। আমি তখনই প্ল্যান করলাম ওনার সঙ্গে যাব। ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন মৃনাল মুখোপাধ্যায়। প্রণব বাবুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন মৃণাল দাকাবে বললাম, উনি বললেন, চলুন। আপনার লেখার ক্লিপিং পেয়েছেন সাহেব। আমি বললাম অনিলচন্দ্র পরই জেলা থেকে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রনব দা। তাই তার বাড়িতে একটু যাব দেখতে। ওদের গাড়িতে করেই আমি চলে গেলাম। লাভপুরে গিয়ে উনার সাথে আমি পরিচয় দিতেই, তিনি বললেন, আমার মনে আছে। এবং আমি সেই আমার লেখার কাটিং সম্পর্কে বলতেই তিনি বললেন, আমার সব মনে আছে। আপনি ভাবছেন আপনার লেখা আমি দেখিনি। কিন্তু আমি দেখেছি। ওই যে গাছের রস ওইটা দিয়ে চোখের ওষুধ তৈরি হয়।আমাকে কাগজে লিখতে বারণ করে তিনি বললেন, মুম্বাইয়ের সারাভাই সংস্থার সঙ্গে ওই ব্যাপারে আমার কথা হয়েছে। তারপরে আমরা হাঁটছি। উনি কিন্নাহার এর কংগ্রেস ভবনে যাবেন। দেখলাম এক প্রবীণ মানুষকে দেখে রাস্তাতেই প্রণাম করলেন প্রণব দা। পরে জানলাম তার নাম শম্ভু প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি পুরনো কংগ্রেস নেতা এবং প্রনব দার স্কুলের শিক্ষক।
তিনি বীরভূম থেকে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী
তিনি এরপরে এগিয়ে চললেন গ্রামের বাড়ির দিকে আমিও একটা এক্সক্লুসিভ করার জন্য যাচ্ছি। গ্রামের লোক তখন জিজ্ঞেস করছে প্রনব বাবুর ডাকনামে, পল্টু তোমার সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করা যাবে তো? বীরভূম থেকে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েছিলেন অনিল চন্দ্। যার স্ত্রী রানী চন্দ। তারপরেই প্রণব দা।
কিন্নাহার এর হাটতলা বাজারে ওনার সম্বর্ধনা। কংগ্রেস এবং নাগরিকদের তরফের সংবর্ধনা হল প্রণব বাবুর। উনি বসেছিলেন। আমি গিয়ে বললাম, এবার আমি বোলপুরে ফিরি। কেননা লেখা আর ছবি ফাইল করতে হবে। তিনি এতটাই ভদ্র আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি যাবে কি করে আমি তোমায় একটা গাড়ি বলে দি। আমি অস্বীকার করলাম। বললাম, এখনো দুটো বাস আছে, আমি ঠিক একটা বাস পেয়ে যাব।
সেই থেকেই আলাপে সূত্রপাত। তারপর ধীরে ধীরে তিনি শীর্ষে উঠেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে উনার সৌজন্যবোধ, ভদ্রতা কোনদিনই তার থেকে দূরে সরে যায়নি।
তুখোড় রাজনীতিক
একবার সভা ইলামবাজারের ঘুড়িষা বাজারে। সম্ভবত সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছেন প্রণব বাবু। ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে না। তবে এটা মনে আছে প্রণব বাবু সেখানে বক্তব্য রাখছেন। কলকাতা থেকে ও সাংবাদিকরা গিয়েছেন সেখানে।
ওখানে উনাদের মঞ্চ কভার করতে গিয়েও একটু উসখুস করছি। কেননা খানিকটা দূরেই রয়েছে জ্যোতিবাবুর সভা। ফলে ঘুড়িষা থেকে ইলামবাজার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌঁছতে হবে। উনি মনে হয় আঁচ করলেন আমাদের মনের কথা। উনি আমাদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলেন। বললেন, রাতে টেলিফোনে জানিও কি বললেন জ্যোতি বাবু।
শিল্পীর সন্মান
তখন তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। বোলপুরে কোন একটা বীমা সংস্থার শাখা খোলা হচ্ছে। প্রণব বাবু এসেছেন। এসেছেন দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। তিনি তখন শান্তিনিকেতনে ছিলেন। বীমাসংস্থার লোকেরাই হইতো ওনাকে ডেকেছেন। মঞ্চে বসেই দ্বিজেন দা কে দেখেছেন তিনি। উঠে বললেন, এখানে আমার বক্তৃতা করা মানায় না। এখানে আমাদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। আমি ওনার অনুমতি না নিয়েই বলছি, এখানে উনি যদি এসে দু -একটা গান শোনান।
আরেকবার এর ঘটনা। কোন ব্যাংকের একটা মধ্যাহ্ন আহার আয়োজন ছিল। সেখানে চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বিশিষ্টজনেরা এসেছেন। অর্থমন্ত্রী রয়েছেন। ওরা ওয়েট করছেন অর্থমন্ত্রী খেতে আসবেন বলে। কিন্তু আমি ওনাদের বললাম উনি তো খাবেন না। কারণ শনিবারে উনি উপস করেন। এবারে বিরম্বনায় পড়লেন সরকারি অফিসার রা। আমি তখন গেলাম প্রণব বাবুর ঘরে। সেখানে উনাকে বললাম যে আপনি না গেলে খাওয়া শুরু হতে পারছে না। তখন উনি সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন উনি এসে শুরু করতে বললেন। কিন্তু নিজে খেলেন না।
রাতে নিয়মিত গান শুনতেন
সেখানে কথা হচ্ছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের তখন সদ্য একটা কবিতার বই মুক্তি পেয়েছে। ওটা নিয়ে কথা চলছিল। উনি বললেন আমার এখনো কেনা হয়নি। কলকাতায় গিয়ে কিনব। সেই কথা শুনে সেই ব্যাংক কর্তারা প্রায় এমন তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ হল,দেখে মনে হচ্ছে যে তারা অর্থমন্ত্রী কে খুশি করতে, পারলে কলেজ পাড়ার সব বই কিনেই উনাকে উপহার দেন।
বারেবারেই দেখেছি শুধু রাজনীতি, অর্থনীতি নয়, গান কবিতা তিনি নিয়মিত শুনতেন – পড়তেন। উনি প্রতিরাতেই রবীন্দ্র সংগীত শুনতেন। ওনার সঙ্গে নির্বাচন কভার করার সময় দেখেছি একদিন বোলপুরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়িতে গেছেন। মোহরদি র সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ওনার স্ত্রী সুভ্রাদির। প্রণব দা বললেন, শুতে যাওয়ার আগে আপনাদের গান নিয়মিত শুনি। আপনার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান।
প্রখর স্মৃতিশক্তি
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার ওনার স্মৃতিশক্তি। আমার মনে পড়ছে উনি তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। vice-chancellors শান্তিনিকেতনের দিলীপ কুমার সিনহা। একটা সেমিনারে যোগ দিতে এসেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা ও রবীন্দ্রনাথ। এই বিষয়ে তিনি বলতে শুরু করলেন উনার বাবা কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে। তারপরে কালীমোহন ঘোষ, শান্তিদেব ঘোষের বাবার সম্পর্কে বলেছেন। দুর্ভাগ্যের কথা সেদিন কোন কারনে শান্তিনিকেতনের রেকর্ডিং মেশিন খারাপ ছিল। প্রণব বাবু একটানা না দেখে বলে গেলেন উনার বক্তব্য। তিনি বলা শেষ করলেন ইন্দিরা গান্ধী থেকে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এমন বহু রাষ্ট্রপ্রধানদের জন্ম মৃত্যু সাল তারিখ বলে গেলেন। একনাগাড়ে। কোথাও কোন চিরকুট নেই।
এই স্মৃতিশক্তি বাড়ে বাড়ে অবাক করেছে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুধীন দত্তের থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় -যে কোন কবির কবিতায় তিনি গড় গড় করে বলে যেতেন। একটা মানুষ বড় হলে অনেক কিছু থাকতে হয়। প্রণব বাবুকে দেখে তাই বারে বারে মনে হতো।