সভ্যতা গড়ে ওঠার সঙ্গে লোহার ভূমিকা অত্যন্ত ঘনিষ্ট। যদিও সোনার প্রভাবের ধারেকাছে নেই কোনো ধাতব পদার্থ। আধুনিক সভ্যতার শুরুর কাল থেকেই মানুষ সোনার জন্য বিপুল ভাবে আগ্রহী এবং আকুল। খ্রিস্টজন্মের ৪০ হাজার বছর আগে সোনা মিলেছিল প্রাচীন প্যালিওলিথিক যুগের গুহায়। সোনা যে মানুষকে মুগ্ধ করেছে তার প্রমাণ মেলে অধিকাংশ প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও সাক্ষ্যে। এমনকি বহু ঐতিহাসিক দলিলে এই মূল্যবান চকচকে ধাতুটির উল্লেখ রয়েছে। সোনা বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে মিসরীয় সভ্যতায়। মিশরের গিজার পিরামিডের ক্যাপস্টোন তৈরি হত খাঁটি সোনা দিয়ে। মিসর সম্রাট বা ফ্যারো এবং ধর্মীয় যাজকরা অনেক সময়েই পুরস্কার হিসেবে সোনা প্রদান করতেন। মিসরীয়রাই প্রথম বিনিময়যোগ্য স্বর্ণমুদ্রার ধারা প্রতিষ্ঠা করে। তারাই কোথায় সোনা পাওয়া যায়, কোথায় সোনার খনি—এই সব চিহ্নিত করে মানচিত্র বা গোল্ড ম্যাপ তৈরি করেছিল। তবে মিসরীয়রা জিনিসপত্র কেনা বেচার জন্য স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার শুরু করেনি। অর্থ হিসেবে প্রথম সোনার ব্যবহার শুরু হয় একালের তুরস্কের পশ্চিমাংশে কিংডম অব লিডিয়াতে। সোনার অর্থমূল্য ও সামাজিক মূল্যের ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত করে প্রাচীন গ্রিকরা। যদিও মনে করা হয় অলিম্পিকে স্বর্ণপদকের ধারণাটি প্রাচীন গ্রিকদের কিন্তু তার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।

প্রাচীন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে এদেশে সোনার চল ছিল বহু বছর আগে থেকেই। বেদ, উপনিষদ, মহাভারত, রামায়ণ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ, জৈন, সংস্কৃত সাহিত্যে সোনার উল্লেখ যেমন পাওয়া যায় তেমনই ঋকবেদে উল্লেখ আছে যে হোম-যজ্ঞ অনুষ্ঠানের জন্য পাত্রটিকেও সোনার হতে হবে। তাছাড়া ঋকবেদে সিন্ধু নদে সোনা পাওয়ার উল্লেখ আছে। সোনার গয়নার প্রচলন ছিল হরপ্পা সভ্যতায়। যে সব দেখা যায় দিল্লির জাতীয় জাদুঘরের ‘হরপ্পা’ গ্যালারিতে। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যায় যে, ভারতে সোনার ব্যবহার ছিল নিওলিথিক (প্রস্তর যুগের শেষ পর্যায়) এবং চ্যালকলিথিক (প্রস্তর যুগ থেকে ধাতব যুগের মধ্যে; যে সময় তামার ব্যবহার হতো)যুগে। যদিও প্রথম দিকে সোনা বের করা হতো নদীর ধারে আলুভিয়াল বালি ঘেঁটে কিন্তু ভারতে প্রথম স্বর্ণখননের কাজ শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে কর্ণাটকের মাস্কি এলাকায়। গুপ্ত যুগে (তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে) কর্ণাটকেরই কোলার খনির চ্যাম্পিয়ন রিফের থেকে সোনা পাওয়ার জন্য ৫০ মিটার নীচ পর্যন্ত খোড়া হয়েছিল। মহাভারতেও পাওয়া যায় স্বর্ণ বহনকারী নদীর কথা (রাজা সুহত্রার রাজ্যে), যা দিয়ে বোঝানো হয় কেন পৃথিবীকে বসুমতী বলা হয়। তবে মহাভারতে যে পিঁপড়ে দিয়ে সোনা খোঁড়ার কথা বলা আছে সেটা খুব সম্ভবত গুঁড়ো সোনার কথা, যা নদীর ধারে বা নদীর ভেতরের পাথরের গায়ে পাওয়া যায়। যেসব জায়গায় একসময় সোনা পাওয়া যেত সেগুলির এখনো ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাদের নামের মধ্যে যেমন সুবর্ণরেখা, স্বর্ণমুখী, সোনাজরী, সোনাপাহাড়ি, সোনেপাত ইত্যাদি। তেমনি এখনো ভারতে অনেক উপজাতির কথা শোনা যায় যারা নদীর ধারের বালি থেকে সোনা ছেনে বের করার কাজে বিশেষজ্ঞ, যেমন সঞ্ঝারিয়া, ঝারিয়া, সনযারাস, তরাস, ডোকরা, বালটি ইত্যাদি উপজাতিরা।

যদিও ভারতে সোনার প্রচলন সেই নিওলিথিক অথবা চ্যালকলিথিক যুগ থেকে কিন্তু কিভাবে সোনা খনন করা হতো অথবা খননের সঠিক পদ্ধতি কী ছিল তা নিয়ে কিছুটা হলেও ধোঁয়াশা রয়েছে। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, প্রাচীনকালের কোনো খনি দেখলে বোঝা যায় যে সেই সময় ফায়ার সেটিং টেকনিক ব্যবহার হতো। এই টেকনিক অনুযায়ী খনির পাথর ভাঙার সময় একবার আগুন দিয়ে পাথরটাকে প্রচণ্ড তাতিয়ে নিয়ে আবার সেটাকে আচমকা ঠাণ্ডা করা হতো। এই প্রক্রিয়া চালানো হতো যতক্ষণ না পাথরটা ভেঙে যায়। তারপর ভাঙা পাথরকে গুঁড়িয়ে তার থেকে আকরিক ধাতু থেকে সোনা বের করা হতো। প্রাচীন গ্রন্থ আর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানা যায় প্রাচীনকাল (৩৯০০ খ্রিস্টপূর্ব) থেকে সোনার জন্য যেমন ভারতে খননের কাজ হয়েছে, ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৭০ ভারতের স্বর্ণ খননের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়, তবে বিদেশ থেকে স্বর্ণ আমদানির কাজ জোরকদমে শুরু হয়, আবার ১৮৭০ থেকে ভূতাত্ত্বিকদের নেতৃত্বে নতুন প্রযুক্তির সাহায্যে সোনার জন্য খননের কাজ শুরু হয় কোলার, হুত্তি, গাদাগ এবং রামগিরি প্রভৃতি সোনার খনিতে। ২০০১ সালে ৩০০০ মিটার পর্যন্ত খননের পর কর্ণাটকের কোলার খনির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। মাটির নীচে জলের স্তর এসে যাওয়া কিংবা অন্য নানা কারণে ৬০০-৭০০ পর্যন্ত খননের পরেও  কিছু প্রাচীন খনির কাজ বন্ধ হয়ে যেত।  

Macro dolly shot of pyrite mineral on black background

রাসায়নিক ধাতু Au (সোনা)-র উজ্জ্বলতা এমনই কুহেলিকাময় যে হাজার বছর ধরে মানুষ সোনার মালিকানা পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছে, পাহাড় ভেঙেছে। সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা এবং বিজয়ের কারণও সোনা। যদিও মানবজাতিকে টিকে থাকার জন্য সোনা অত্যাবশ্যক নয়; বস্তুতপক্ষে মানুষের জীবনে সোনার কার্যকরী ব্যবহার খুব সামান্য। কিন্তু সম্পদ ও সৌন্দর্যের প্রতীক হওয়ায় সোনাই পৃথিবীর সবচেয়ে ঈপ্সিত বস্তু। এখনো অনেক সংস্কৃতিতে এমন বিশ্বাস আছে যে সোনা মানুষকে অমরত্ব দান করতে পারে। দুনিয়ার সব দেশ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু তারপরও সোনার প্রতি আকর্ষণ কমেনি বরং বিশ্বের অর্থনৈতিক অস্থিরতায় আরও বেড়েছে।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version