শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো, মিস মার্পলদের কীর্তিকলাপ অনেক জানা হলেও আরও অনেক গোয়েন্দাদের কথা তেমন জানা হয়নি। ড. জন থর্নডাইক, গোয়েন্দা ফাদার ব্রাউন, ইন্সপেক্টর মেগ্রে, আঙ্কল আবনার প্রমুখ। প্রথমে বলি ড. জন থর্নডাইকের কথা। তাঁর কাছে সব সময়েই থাকে একটি অ্যাটাচি কেস। ওর মধ্যেই তাঁর দরকারি সব বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি থাকে। হ্যাঁ বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি কারণ, ক্ষুদ্র ধূলিকণা থেকে আগাছা, তাঁর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ থেকে কিছুই প্রায় বাদ পড়ে না। এ ব্যাপারে তাঁকে শার্লক হোমসের চেয়েও কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখা যায়। হোমসের সঙ্গে তাঁর একটি বিষয়ে বিরাট ফারাক, হোমস তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল পাঠকের কাছে কখনই মেলে ধরতেন না কিন্তু থর্নডাইক তাঁর বিচার বিশ্লেষণের প্রায় পুরোটাই পাঠককে অবহিত করেন। হোমস বা তার স্মসাময়িক গোয়েন্দাদের সঙ্গে তাঁর আরও একটি ব্যাপারে যথেষ্ট পার্থক্য আছে, থর্নডাইক পুলিশকে অবজ্ঞার চোথে দেখেন না, বরং তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই কাজ করেন তিনি।
ফাদার ব্রাউন একজন ধর্মযাজক হয়েও যে কিভাবে একটি সফল গোয়েন্দা সিরিজের নায়ক তা সত্যিই ভাবা যায়না। এটা যে কিভাবে সম্ভব হয়েছে তা একমাত্র গিলবার্ট কিথ চেস্টারটনই পেরেছিলেন। তিনিই একটি গির্জার পাদরি ফাদার ব্রাউনকে একজন গোয়েন্দা বানিয়েছেন। ব্রাউনের বগলে ধরা বিশাল ছাতা, মাথায় টুপি আর সাদামাটা পোশাক দেখে যে কারও একজন অতি সাধারণ লোক ছাড়া অন্য কিছু ভাবার উপায় নেই। অথচ তিনি মানবমনের অশুভ প্রবণতা সম্পর্কে আসাধারণ জ্ঞান রাখেন। শার্লক হোমসের মতো ধাপে ধাপে নয়, কেবল জ্ঞান ও অভিঙ্গতার উপর নির্ভর করেই তিনি রহস্যের সমাধান করেন। কিন্তু পাদরি হয়ে মানুষের অশুভ দিকের এত কিছু জানলেন কিভাবে? ফাদার ব্রাউন জানান, পাদরি হওয়ার কারণেই জানা সম্ভব হয়েছে, কারণ ভালো-মন্দ সব ধরনের মানুষই তাঁর কাছে নিজের পাপের স্বীকারোক্তি করতে আসে।
একেবারে গোড়ায় গোয়েন্দা সাহিত্যের নায়ক ছিল পুলিশ। পুলিশের মোটা বুদ্ধি, আত্মম্ভরিতা আর সবজান্তাভাব নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করাটাও ছিল একটা সাধারণ বিষয়। কিন্তু পরবর্তীতে হাসির পাত্ররাই দেখা গেল গোয়েন্দা গল্পের নায়ক হয়ে উঠেছে। আধুনিক গোয়েন্দা সাহিত্যে তো একচেটিয়া নায়কই পুলিশ। এই পুলিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ইন্সপেক্টর মেগ্রে। তাঁর সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ফরাসি গোয়েন্দা চিফ ইন্সপেক্টর মার্সেল গিয়মের আদলে ইন্সপেক্টর মেগ্রে চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন জর্জ সিমেনো। তাঁর কাহিনিগুলিতে অন্য সব গোয়েন্দা কাহিনির মতো অসাধারণ বুদ্ধির খেলা আছে ঠিকই কিন্তু তার বাইরে আছে পুলিশ বাহিনীর দলবদ্ধ কর্মকাণ্ড। অর্থাৎ এখানে রহস্য সমাধান করতে একক কোনো নায়কের ভূমিকা নেই, পুরো একটা দলই এখানে নায়ক।
মেলভিন ডেভিসন পোস্ট সারা জীবনে মোট ছটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। তার মধ্যে অধিকাংশের বিচারেই শ্রেষ্ঠ আবনার। অনেকের বিচারে অ্যালান পোর দুঁপার পর গোয়েন্দা সাহিত্যে মার্কিনদের শ্রেষ্ঠ দান। সব অর্থে অতি সাধারণ একজন মানুষ এই আবনার। গ্রামে সবার তিনি আঙ্কেল। ধর্মভীরু এই বৃদ্ধের বিশেষ কোনো ক্ষমতাও নেই। তার বদলে আছে সাধারণ জ্ঞান আর দূরদৃষ্টি। এী দুটিকে সম্বল করেই গোয়েন্দা সাহিত্যের অসাধারণ কিছু রহস্যের সমাধান করেছেন এই বুড়ো আঙ্কল আবনার আর তাঁর ভেক সম্পর্কীয় নাতি বর্ণনা করেছেন ঘটনাগুলি।
শার্লক হোমসের সমসাময়িক, একই সঙ্গে স্ট্রান্ড ম্যাগাজিনে তাঁর কীর্তিকলাপও ছাপা হত। সূচিপত্রে প্রায়শই হোমস ও ডয়েলের ওপর থাকত ম্যাক্স কারাডোস ও আর্নেস্ট ব্রামার নাম। শোনা যায় সেই সময় হোমসের চেয়ে নাকি বেশি বিক্রি হত কারাডোস। কারাডোস অন্ধ হলেও গোয়েন্দা। তাঁর গল্পগুলি আমাদের শুনিয়েছেন আরেক প্রাইভেট গোয়েন্দা কার্লাইল। একটা মুদ্রার ব্যাপারে আলাপ করতে গিয়ে কারাডোসের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। এই পরিচয়ের ১২ বছর আগে এক দুর্ঘটনায় অন্ধ হয়ে যায় কারাডোস। কিন্তু বাকি ইন্দ্রিয়গুলি তিনি এমন দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেন যে তাঁর অন্ধ হওয়ার দুর্বলতা অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই তিনি রহস্য সমাধান করেন।
ম্যাক্স কারাডোসের মতো নেরো উলফকেও বলা যেতে পারে প্রতিবন্ধী গোয়েন্দা। কারাডোসের দৃষ্টিশক্তি নেই আর উলফ চলাফেরা করতে অক্ষম। তবে তাঁর এই অক্ষমতার কারণ তিনি অতিরিক্ত স্থূল। তিনি এতই মোটা যে রেডিমেড চেয়ারে তাঁর শরীর কুলায় না, রীতিমতো অর্ডার দিয়ে চেয়ার বানাতে হয়। তিনি মূলত আর্মচেয়ার ডিটেকটিভ। বাড়িতে বসেই রহস্যের সমাধান করেন। নড়াচড়া করাটা তাঁর দু’চোখের বিষ। দীর্ঘ গোয়েন্দাজীবনে তিনি কতবার বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, আঙুল গুনেই বলে দেওয়া যায়। তারপরও বাইরে কোনো কাজ করাতে হলে তার জন্য সহকারী আছে। তার তিন প্রেম হচ্ছে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা আর অর্কিড। কিন্তু রেক্স স্টাউটের এই সিরিজ গোয়েন্দা লেখকদের বিচারে শতাব্দীর সেরা গোয়েন্দা সিরিজ হিসাবে নির্বাচিত।
সংঘবদ্ধ অপরাধের আমলে মার্কিন সাহিত্যে নতুন এক ধরনের গোয়েন্দার আবির্ভাব হয় ১৯২০-এর দশকে, ধরনটির নাম হার্ড বয়েলড। এই গোয়েন্দাদের যেমন সংঘবদ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, তেমনি আবার তাদের প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দেয় দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ। আগের আমলের গোয়েন্দাদের কখনো এই ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করতে হয়নি। পুলিশ নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করলেও এই শক্তিটা বরাবর তাদের সহায়কই ছিল। অন্যসব গোয়েন্দাদের তুলনায় এদের নীতিনৈতিকতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। রেফলস চোর হলেও তারও আছে কিছু নীতি। কিন্তু হার্ড বয়েলড গোয়েন্দাদের ওসবের বালাই নেই। উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বাঁকা পথে যেতেও এরা পিছপা হয় না। পয়সায় বিনিময়ে ক্লায়েন্টের অসাধু উদ্দেশ্য পূরণেও এরা এক পায়ে খাড়া। এই ঘরানারই প্রথম সার্থক গোয়েন্দা স্যাম স্পেড। লেখক ড্যাশিল হ্যামেট নিজেও প্রথম জীবনে পিঙ্কারটন ন্যাশনাল ডিটেকটিভ এজেন্সিতে কাজ করেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে কাহিনিগুলি লিখতে পেরেছিলেন।