দ্বিতীয় পর্ব

রামকানাই ভিক্ষা করে স্নান সেরে ইষ্ট দেবতার পুজোয় বসতেন। কৃষ্ণ পুজোর জন্য তিনি নানারকম ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। সেদিন তাঁর লাগানো গাছের ফুল তুলতে গিয়ে দেখেন, কোনও গাছে ফুল ফোটেনি একমাত্র মাধবী গাছ ছাড়া। কিন্তু সে গাছটি ফুল সমেত কাটা অবস্হায় মাটিতে লুটিয়ে আছে। রামকানাই ছেলেদের জিজ্ঞাসা করে কোনো উত্তর না পেয়ে, দেবতার চরণে ফুল দিতে না পারার যন্ত্রণায় বললেন, “যে ফুল গাছ কেটেছে তার তিন দিনের মধ্যে মৃত্যু হবে।”

তাঁর অভিশাপের ফলে তিনদিন পর ছোটো ছেলে রাখালের মৃত্যু হলো। তিনি তাঁর ইষ্ট দেবতার কাছে কেঁদেও রাখালকে ফিরে পেলেন না। মনের দুঃখে বৃন্দাবনের পথে হাঁটতে থাকলেন। পথ-ক্লান্ত রামকানাইকে তাঁর ইষ্ট দেবতা স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন, তাঁর নিজের গ্রামই বৃন্দাবন, কেন সে অতদূরে যাচ্ছে? তিনি রামকানাইকেগ্রামে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর রামকানাইবাড়ি ফিরে স্বপ্নের নির্দেশ মতো নিমকাঠ দিয়েদেবতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি কথিত মতে যমুনা নামক পুকুরে ভেসে উঠেছিল। মূর্তিটি বানিয়েছিল বাঘনাপাড়ার পাঁচ বছরের এক বালক।

জনশ্রুতি মুর্শিদকুলির খাঁয়ের আমলে পোঁটবার জমিদার গোপাল দাস শিকারে বেরিয়ে এই এলাকার গভীর জঙ্গলে একদিন সন্ধ্যায় তাঁবু ফেলেন। সন্ধ্যার সময় তিনি জঙ্গলে কাঁসর, ঘন্টা, শঙ্খ ধ্বনি শোনেন। সেই আওয়াজ অনুসরণ করে তিনি জঙ্গলের মধ্যে একটি বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখেন একজন কৃষ্ণের পূজা করছেন। গভীর জঙ্গলে এই দৃশ্য দেখে তিনি অবাক হন। রামকানাইও গোপালদাসকে দেখে অবাক হন। তিনি গোপালদাসের আসার কারণ জানতে চান। এরপর তিনি তাঁদের সকলকেই ভোগ খাবার অনুরোধ করেন। কিন্তু সামান্য ভোগ থাকলেও সেদিন জমিদার ও তাঁর সঙ্গীদের সকলের পেট ভরে যায়।     

এরপর গোপাল দাস রাখাল রাজার মন্দির তৈরি করেন ও রাখাল রাজার ভোগের জন্য সম্পত্তি ও মন্দিরকে সাতশো বিঘা জমি দান করেন। ১৭৭৫ সালে এই মন্দির তৈরি হয়।

গোপাল দাসের নাম অনুসারেই গ্রামের নাম গোপালদাসপুর। মন্দির প্রাঙ্গণ খুবই সুন্দর। ফাঁকা মাঠের মধ্যে বড় বড় বট, অশত্থ, করবী ও নানান গাছ। মন্দিরের পাশেই যমুনা পুকুর যা পবিত্রতার নিদর্শন। মন্দিরকে ঘিরে বয়ে চলেছে একটি খাল, যেন এক তপোবন। রয়েছে রামকানাই গোস্বামীর সমাধি মন্দির।

এই এলাকায় সীতারাম ভক্ত সহ এসেছেনও বহু সাধু সন্ন্যাসী।বর্তমানে ছায়াঘন পরিবেশের আকর্ষণে দূর-দূরন্ত থেকে পর্যটক আসে।

বংশপরম্পরায় রামকানাই গোস্বামীর পরিবারের লোকজনই পৌরহিত্য করে আসছেন। যদিও এখন পালা করে পূজা-পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। ভাত, ডাল, শুক্ত, চরচরি, চাটনি, পায়েস রোজ দুপুরে ভোগ দেওয়া হয়। এখানে এলে প্রসাদ না পেয়ে কেউই ফিরে যায় না। তবে এখন পঁচিশ টাকা করে মূল্য দিতে হয়। পূজারীরাই ভোগের ব্যবস্থা করেন। মন্দির সংলগ্ন প্রশস্ত মাঠটি বেশ সুন্দর।

হাওড়া বর্ধমান মেন লাইনের যে কোনো লোকাল ট্রেনে বৈঁচি নেমে, স্টেশন থেকে কালনাগামী যেকোনো বাসে বৈদ্যপুরের রথতলা নেমে টোটোতে গোপালদাস পুরের রাখাল রাজার মন্দির যাওয়া যায়।অথবা, হাওড়া কাটোয়াগামী ট্রেনে কালনা নেমে, বৈঁচিগামী বাসে বৈদ্যপুর রথতলা নেমে টোটোতে রাখাল রাজার মন্দির পৌঁছানো যায়, দূরত্ব আনুমানিক পনেরো কিলোমিটার।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version