উপমহাদেশের গণসংস্কৃতি আন্দোলনের প্রবাদ প্রতিম শিল্পী সংগ্রামী হেমাঙ্গ বিশ্বাস। জন্ম শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার চুনারুঘাটের মিরাশী গ্রামে। জমিদার পিতার সন্তান হয়েও রাজনৈতিক মতাদর্শে এবং অঙ্গীকারে নিজের শ্রেণির সীমা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক গান শেখা তাঁর হয়নি। শৈশবে স্কুলে যাওয়ার পথে গান গেয়ে গেয়ে স্কুলে যেতেন। লোকসঙ্গীতের আবহ দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছে যাওয়া যায়- তাই লোকসঙ্গীতের আঙ্গিকে জীবনভর গণমানুষকে উজ্জীবিত করতে গেয়েছেন গণসঙ্গীত। প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন ও সংগঠিত করতেই গান রচনা করেছেন, সুর দিয়েছেন এবং গেয়েছেনও। 

কলেজছাত্র হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে ৬ মাস কারাভোগ করেন এবং কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। স্বদেশি আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় আবার গ্রেফতার হয়ে একটানা তিন বছর কারাভোগ করেন। তখনই মারাত্মক যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। বন্ড দিয়ে জেলমুক্তির রাষ্ট্রীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেও মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ব্রিটিশ সরকার তাকে মুক্তি দিয়ে দায়মুক্তি নিয়েছিল। জেল জীবনে কংগ্রেসের অহিংস নীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে মার্কসবাদী রাজনীতির শিক্ষা-দীক্ষায় কমিউনিস্ট মতাদর্শে ঝুঁকে পড়েন। নেতাজি সুভাষ বসু হবিগঞ্জে এলে তাঁর সংবর্ধনায় সংবর্ধনাপত্র পাঠ করেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস। চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন এবং ডিকবয় তেল কোম্পানির শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদে সংঘটিত আন্দোলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাসই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সিলেট তখন আসাম প্রদেশের অংশ। হেমাঙ্গ গানের স্কোয়াড নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন আসাম প্রদেশ। কমিউনিস্ট হেমাঙ্গকে জমিদার পিতা বাড়ি থেকে বিতাড়িত করলে তিনি চলে যান সিলঙে। আমৃত্যু হেমাঙ্গ আর ফিরে যাননি।  

১৯৪৬ সালে আসাম প্রদেশ গণনাট্য সংঘ গঠিত হলে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং পরপর তিনবার ওই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৪৭-এ গণনাট্য সংঘ এবং কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা দেশভাগের শিকার হন। দেশভাগের নিষ্ঠুর পরিণতিতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য দেশজুড়ে সাড়া ফেলেছিল। ১৯৪৮ সালে তেলেঙ্গানা ও তেভাগা কৃষক বিদ্রোহ দমনে স্বাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। হাজার হাজার কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন-পীড়ন এবং গণগ্রেফতার করা হয়। ১৯৫১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গ্রেফতার হলেও অসুস্থতার কারণে ছাড়া পেয়ে যান। ১৯৫৭ সালে সুচিকিৎসার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে তাকে চীনে পাঠানো হয়। টানা তিন বছর চীনে চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় চীনা ভাষাও রপ্ত করেছিলেন। চীনা ভাষায় তার অনেক গানও রয়েছে। 

মুজাফ্ফর আহমেদের সুপারিশে কলকাতার সেভিয়েত কনস্যুলেটে তাঁর চাকরি হয়। পরবর্তীতে চীন-সোভিয়েত মতাদর্শগত বিভাজনে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনও বিভক্ত হয়ে পড়ে। সোভিয়েত পার্টির সমালোচনার কারণে তিনি সোভিয়েত কনস্যুলেটের চাকরি ছেড়ে দেন। ১৯৬৯ সালে নকশাল বাড়ি আন্দোলনকে তিনি প্রকাশ্যে সমর্থন করেন। ১৯৭১ সালে হেমাঙ্গ বিশ্বাস গঠন করেন ‘মাস সিঙ্গার্স’ নামক গণসঙ্গীতের গানের দল এবং আমৃত্যু এই দল নিয়েই ঘুরে বেড়িয়েছেন। 

নাটক, যাত্রা এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। উৎপল দত্তের কল্লোল ও তীর নাটক উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তেলেঙ্গানা ১৭৯৯, লাল লণ্ঠন, লেনিন, পদ্মানদীর মাঝি, বিদুন, রাইফেল, রাহুমুক্ত রাশিয়া, মানুষের অধিকারে, কাঙ্গাল হরিশ, চাঁদ-মনসার নৃত্যনাট্য প্রভৃতি নাটক ও যাত্রাপালার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। লালন ফকির চলচ্চিত্রে সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তার সুরে গান গেয়ে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও অসমীয়া, ইংরেজি এবং চীনা ভাষায়ও তার সমান দক্ষতা ছিল।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version