আমসত্ত্ব দুধে ফেলি,         তাহাতে কদলী দলি,

সন্দেশ মাখিয়া দিয়া তাতে—

হাপুস হুপুস শব্দ            চারিদিক নিস্তব্ধ,

পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।

এটি কি কোনও কবিতা না স্রেফ ছড়া? যখন থেকে এটি জানা তখন থেকে মনে হয়েছে এটা একটা লেখা। জাস্ট একজন হয়ে ওঠার মকশো। কিন্তু কোনও কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে একটি পিঁপড়ের নিজের ওজনের চেয়ে বেশি চিনির একটি দানা বয়ে নিয়ে যাওয়া দেখেতে আমসত্ত্ব দুধে ফেলি মনে এল। আর সেদিনই ভাবতে ভাবতে মনে হল ওই লেখাটির প্রথম তিনটি পঙক্তি নিছক লেখা, যে কেউ নীরেন্দ্র চক্রবর্তীর ‘কবিতার ক্লাস’ পড়ে লিখে ফেলতে পারে। কিন্তু, শেষ পঙক্তিটিতেই রয়েছে কবিতার ভ্রূন। একটি চারাগাছে বটবৃক্ষের সমগ্রতা। ‘পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।’ — একজন কবির আবির্ভাব বার্তা।

রবীন্দ্রনাথ অতি অল্পবয়স থেকেই আত্মপ্রচারে কৃপণ ছিলেন না। জীবনস্মৃতি পাঠ করলেই তা পাওয়া যায়। তিনি নিজেই লিখছেন, ‘আমি কবিতা লিখি, এ খবর যাহাতে রটিয়া যায় নিশ্চয়ই সে-সম্বন্ধে আমার ঔদাসীন্য ছিল না।’ সেই সুবাদেই তাঁদের শিক্ষক সাতকড়ি দত্ত একদিন তাঁকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি নাকি কবিতা লিখিয়া থাক।’ বালক রবীন্দ্রনাথ  গোপন করেননি। জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘ইহার পর হইতে তিনি আমাকে উৎসাহ দিবার জন্য মাঝে মাঝে দুই-এক পদ কবিতা দিয়া, তাহা পূরণ করিয়া আনিতে বলিতেন। তাহার মধ্যে একটি আমার মনে আছে— রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই,/ বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।’ রবি ঠাকুর তার পাদপূরণে লিখেছিলেন…’মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে,/এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।’

আত্মপ্রচারের অঙ্গ কিনা জানি না, তবে অতি শৈশব থেকেই নিজের কবিতা অন্যকে শোনানোর স্বভাব ছিল রবি ঠাকুরের। তাঁর কবিতা যখন ছাপাখানর মুখও দেখেনি তখনই তিনি তা অন্যকে শোনাবার চেষ্টা করতেন। ‘জীবনস্মৃতি’তে নিজেই অকপটে বলেছেন, ‘হরিণশিশুর নূতন শিং বাহির হইবার সময় সে যেমন যেখানে-সেখানে গুঁতা মারিয়া বেড়ায়, নূতন কাব্যোদ্‌গম লইয়া আমি সেইরকম উৎপাত আরম্ভ করিলাম।’ এই উৎপাতের একটা সেরা নমুনা নবগোপাল মিত্রকে কবিতা শোনানো। নবগোপাল মিত্র তখন ন্যাশনাল পেপার’-এর সম্পাদক। বাড়িতে তাঁকে কাছে পেয়ে পকেট থেকে পাণ্ডুলিপি বের করে কবিতা শুনিয়েছিলেন। পরিবারের বাইরে সম্ভবত নবগোপাল মিত্রই রবীন্দ্রনাথের কবিতার প্রথম শ্রোতা। সেইদিক থেকেও নবগোপাল মিত্র এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। শুধু নবগোপাল মিত্রই নয় বালক রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনতে হয়েছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও। যদিও তা ছিল তরজমা। রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতের গৃহশিক্ষক রামসর্বস্ব পণ্ডিত। তিনি বালককে কালীদাস থেকে পড়াতেন। আর এদিকে রবীন্দ্রনাথ চুপিচুপি শেক্সপিয়র পড়তে পড়তে খোদ ‘ম্যাকবেথ’এর একটি তরজমা দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন৷ রামসর্বস্ব তা শুনে রবি ঠাকুরকে নিয়ে হাজির হলেন খোদ বিদ্যাসাগরের কাছে। ঈশ্বরচন্দ্রেরমতো শ্রোতা পাবেন, এই আনন্দে ১৪ বছরের বালক তখন আত্মহারা। কে না চায় তখন তাঁর কাছ থেকে প্রশংসা। বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তখন ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও পণ্ডিত রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। ১৪ বছরেরবালকের গলায় তাঁরই করা তরজমা শুনে দু’জনেই তাঁকে লেখা চালিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছিলেন।

ঠাকুরবাড়িতে বালক থেকে কৈশোরে পৌঁছনো রবীন্দ্রনাথের ঠাকুবাড়ির ভিতরমহলে সবচেয়ে আদর্শ শ্রোতা ছিলেন কাদম্বরী দেবী, ছোটবৌঠান। আরবাহিরমহলে তাঁর সৃজনশীল রচনার প্রধান দুই শ্রোতা হলেন প্রিয়নাথ সেন এবং লোকেন্দ্রনাথ পালিত। নিজেজীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন, ‘তখনকার দিনে যত কবিতাই লিখিয়াছি সমস্তই তাঁহাকে শুনাইয়াছি এবং তাঁহার আনন্দের দ্বারাই আমার কবিতাগুলির অভিষেক হইয়াছে।’ এই ‘তাঁহাকে’ হচ্ছেন প্রিয়নাথ সেন।

কবির শান্তিনিকেতনের ছাত্র প্রমথনাথ বিশী উল্লেখ করেছেন, ‘পলাতকা ও লিপিকা লিখিবার সময়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় সেদিনের লিখিত অংশ পড়িয়া শুনাইতেন। সভায় বৈদেশিক অধ্যাপক কেহ থাকিলে তাঁহাদের জন্য সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদও করিয়া যাইতেন।’ আমরা জানি, জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। নিয়ম করে প্রায় প্রতিটি শনি-রবিবার শিলাইদহে কাটিয়ে যেতেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। কবির কাছে বিজ্ঞানীর দাবি, প্রতি সপ্তাহে একটি করে নতুন গল্প তাঁকে শোনাতে হবে। সে দাবি কবি শুধু পূরণই করেননি, উপরি হিসেবে বন্ধুকে নতুনলেখা গল্পটি পড়েও শোনাতেন। সম্ভবত শোনানোর আগ্রহটা কবির দিক থেকেই ছিল বেশি। কেননা, আমরা কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের লেখা থেকে জানতে পারি। তখন কবি সপরিবার শিলাইদহে। কবিপুত্র জানাচ্ছেন, ‘লেখা সবেমাত্র শেষ হয়েছে, বাবা মাকে বললেন, ‘আমার গল্পটা লেখা শেষ হয়ে গেছে, আমাকে এখনি কলকাতায় যেতে হবে।’ এই কথা শুনে মা কিছুমাত্র আশ্চর্য হলেন না। তিনি জানতেন, কোনো লেখা শেষ হলে সাহিত্যিক বন্ধু-বান্ধবদের সেটা যতক্ষণ না পড়ে শোনাচ্ছেন— বাবা স্বস্তি বোধ করতেন না। এই অভ্যাস তাঁর বরাবর থেকে গিয়েছিল।’

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version