তাঁর মুখের মৃদু হাসি আর শান্ত ও নম্র স্বভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিনি একাধিক ব্যক্তিকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছেন। সেই তিনি ১৯৭০-র দশকে গোটা এশিয়া জুড়ে ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন। গোয়া থেকে থাইল্যান্ড, এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় খুন, ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। মূলত বিদেশি পর্যটকদেরই নিশানা বানাতেন তিনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর হাতে নিহত পর্যটকদের বিকিনি পরা অবস্থায় পাওয়া যেত। তাই তাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ‘দ্য বিকিনি কিলার’।

তাঁর জন্ম ভিয়েতনামের সাবেক সাইগনে। এখন সেই শহরটির নাম হো চি মিন সিটি। তাঁর বাবা শোভরাজ হাতচন্দ ভাওনানি ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। মা, ত্রান লোয়াং ফুন ছিলেন ভিয়েতনামের নাগরিক।। ছোটবেলায় তাঁর মা একজন ফরাসি নাগরিককে বিয়ে করেন। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, ফরাসি প্রেমিকের সঙ্গে মায়ের নতুন সংসার তিনি ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি। তখন থেকেই পরিবারের সঙ্গে বিরোধ, দূরত্ব বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে কুপথে এগিয়ে চলেন তিনি। দামি পাথরের ব্যবসায়ী সেজে মূলত বিদেশি নাগরিকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতেন তারপর সুযোগ বুঝে তাদের মাদক খাইয়ে লুঠপাট ও খুন করতেন।

প্যারিসে এক ডাকাতির ঘটনায় তাঁর প্রথম বার জেল হয়। কিন্তু তাঁর আচার ব্যবহারে জেলকর্তারা মুগ্ধ হয়ে যান। নিজের সেলে তিনি বই রাখার বিশেষ অনুমতিও আদায় করেছিলেন। জেলে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় এক ধনী স্বেচ্ছাসেবীর সঙ্গে। তাঁর সুবাদে প্যারিসের উপর মহলের সঙ্গে তিনি পরিচিত হন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও সেই পরিচিতি তিনি জারি রেখেছিলেন। পাশাপাশি প্যারিসের অন্ধকার দুনিয়ার সঙ্গেও তিনি জড়িয়ে পরেন। এই সময়ে প্যারিসের রক্ষণশীল অভিজাত পরিবারের তরুণী শাঁতাল কোম্পাগ্যানন সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। শাঁতাল তাঁর প্রেমিকের সব অপরাধের কথা জানতেন।  

এক গাড়িচুরি কাণ্ডে ফের অভিযুক্ত হলে গ্রেফতারি এড়াতে তিনি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে ফ্রান্স ছেড়ে এশিয়ার পথে রওনা দেন। নকল নথিপত্র নিয়ে, পূর্ব ইউরোপ ঘুরে তিনি সপরিবারে পৌঁছন মুম্বই। পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও তিনি পর্যটকদের উপর লুঠপাট চালিয়েছিলেন। মুম্বইয়ে তিনি শুরু করেন গাড়ি চুরির চক্র। সেই সঙ্গে জুয়া। কিন্তু এক ডাকাতির ঘটনায় ফের ধরা পড়লেন তিনি। ইতিমধ্যে তিনি কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছেন। সৎ বাবার কাছ থেকে জামিনের টাকা জোগাড় করে সুযোগ বুঝে স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চম্পট দিলেন কাবুল।

কাবুলে তাঁর অপরাধের নিশানা হল হিপি সম্প্রদায়। এখানেও ধরা পড়ে অসুস্থতার ভান করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রক্ষীদের মাদকাসক্ত করে মেয়ে ও স্ত্রীকে কাবুলে রেখে চম্পট দিলেন ইরান। কিন্তু শাঁতাল তাঁর স্বামীর অপরাধ আর মেনে নিতে না পেরে মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসেন প্যারিসে। ইতিমধ্যে তাঁর অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। ভারতও ছিল তাঁর অপরাধের বিচরণক্ষেত্র। দিল্লিতে একদল ফরাসি তরুণকে নিশানা করেন তিনি। বিশ্বাস অর্জনের পরে তাঁদের হাতে তুলে দেন বিষ মেশানো পিল। কিন্তু তিন ছাত্র তাঁর দুরভিসন্ধি বুঝে ফেলে আচ্ছন্ন অবস্থাতেও তাকে ধরাশায়ী করেন। এরপর জায়গা হয় তিহাড় জেলে। বিচারে ফাঁসির বদলে ১২ বছরের কারাদণ্ড হয়। কিন্তু তিহাড় জেলে তিনি দেহের মধ্যে লুকিয়ে রাখা মূল্যবান রত্ন নিয়ে ঢুকেছিলেন। কারাকর্মীদের ঘুষ দিয়ে ছিলেন রাজার হালে। তিহাড় জেলে ১০ বছর থাকার পূর্তি উপলক্ষে কারারক্ষীদের জন্য পার্টি দেন তিনি। সেই পার্টিতে ঘুমের ওষুধ মেশানো খাবার খাইয়ে ফের চম্পট। কিন্তু ধরা পড়েন গোয়ার এক রেস্তোরাঁ থেকে। ফলে কারাবাসের মেয়াদ আরও ১০ বছর বেড়ে যায়। ৫২ বছর বয়সে মুক্তি পেয়ে ভারত থেকে ফিরে যান ফ্রান্সে।

২০০৩ সালে তাঁকে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে দেখতে পান এক সাংবাদিক। খবর পেয়ে কাঠমাণ্ডুর পুলিশ একটি হোটেলের ক্যাসিনো থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৭৫ সালে নেপালে দুই বিদেশি নাগরিককে খুনের ঘটনায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নেপালের কারাগার থেকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বন্দি বিশ্বত্রাস চার্লস শোভরাজ মুক্তি পেল। ইতিমধ্যে তাঁর একাধিক বার ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, অন্তত ১২টি খুনের ঘটনা সে স্বীকার করেছে। একাধিক ভাষায় পারদর্শী শোভরাজ তার সুদর্শন চেহারা এবং আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগিয়ে তিনি বিশ্বের তাঁবর গোয়েন্দা ও পুলিশের চোখে ধুলো দিয়েছে একাধিক বার।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version