মুসলমান কবির শ্যামা সঙ্গীত বললেই কাজী নজরুল ইসলামের কথাই এসে পড়ে। এমন কালী সাধক কিম্বা শ্যামা সঙ্গীত প্রেমী সত্যিই দুর্লভ যিনি “কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন” গানটি শোনেননি। আরও আশ্চর্যের কথা কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ সেনের চেয়েও নাকি নজরুলের লেখা শ্যামাসঙ্গীতের সংখ্যা বেশি। যদিও শ্যামা সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা কেবলমাত্র কালী সাধক কিম্বা কালী আরাধনা উপলক্ষে নয়। শ্যামা সঙ্গীতের যে ভাবাবেগ তা প্রকৃত সঙ্গীতপ্রেমীর মনকে স্পর্ষ করে। হয়ত সেই কারণেই শ্যামাসঙ্গীত রচনা বা পরিবেশনাতে ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে তরজা বাঁধেনি। বরং রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের পাশাপাশি বিভিন্ন মুসলমান কবিও শ্যামা মা ও শ্যামা সঙ্গীতের ভাবাবেগে মজেছেন, তাঁদের কথা ও সুরে ধরা দিয়েছেন কালী কিম্বা মাকালী। এমনকি রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের বহু আগে একাধিক মুসলমান ধর্মে আস্থাবান কবি ‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে’ শ্যামের নাম জপেছেন।

রেকর্ডের যুগে বেশ কয়েকজন ধর্মে মুসলমান সঙ্গীতশিল্পী হিন্দু নাম নিয়ে ভক্তিগীতি ও শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে মহম্মদ কাশেমের কথা আসে সবথেকে আগে যিনি ভক্তিগীতি গাইবার সময় ‘কে মল্লিক’ নাম নিতেন। এর উলটো ঘটনাও রয়েছে—যেমন ধীরেন্দ্রনাথ দাস, চিত্ত রায় প্রমুখ শিল্পী ইসলামি গান রেকর্ড করার সময় গণি মিঞা, দিলওয়ার হোসেন নাম ব্যবহার করেছিলেন। এই সব ঘটনায় যতটা উদার মানসিকতা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল তখনকার রেকর্ড কোম্পানিগুলির বাণিজ্যিক স্বার্থ, কারণ গানের চরিত্র অনুধাবন করে তারা শিল্পীদের নাম বদলে দিয়েছিল।

বরং খোলা মন বা মননের পরিচয় পাওয়া যায় যখন দেখি রামপ্রসাদ সেনের লেখা গান ও সুরে নানা সময়ের ভারতের নানা প্রান্তের সাধক ও কবি-কবীর, নানক, মীরাবাঈ, সুরদাস প্রমুখের সঙ্গীতের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যেমন, রামপ্রসাদের বিখ্যাত গান ‘মন রে কৃষিকাজ জান না…’ এই গানটির দার্শনিক ভাবনার সঙ্গে নানকের ‘ইহু তনু ধরতি’ গানটির পরোক্ষ প্রভাব লক্ষণীয়।প্রসঙ্গত, আল্লাহর প্রেমে মগ্ন হয়েও মরমিসাধক হাছন রাজা বলেন— ‘আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি,/আমি কি তোর যমকে ভয় করি।/শত যমকে তে দিব, সহায় শিবশঙ্করী’। এরই পাশাপাশি হাছনের ব্যাকুল আকাঙ্খা গেয়ে ওঠে— ‘আমি মরিয়া যদি পাই শ্যামেররাঙ্গা চরণ’। বেশ কয়েক পুরুষ হিন্দু ঐতিহ্যের ধারা প্রবহমান ছিল হাছন রাজার রক্তে কিন্তু তাঁর মরমিলোকে সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঠাঁই ছিল না। তাই আল্লহে ভরসা রেখেও কালীর লীলারসে বিভোর হয়ে তিনি গেয়ে ওঠেন- ‘ওমা কালী! কালী গো! এতনি ভঙ্গিমা জান।/ কত রঙ্গ ঢঙ্গ কর যা ইচ্ছা হয় মন।।/ মাগো স্বামীর বুকে পা দেও মা ক্রোধ হইলে রণ…’।

বাংলায় মুসলিম কবিদের মধ্যে একেবারে গোড়ার শ্যামাসঙ্গীত রচয়িতাদের মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় কবি সা বিরিদ খাঁ-এর কথা। তিনি চট্টগ্রামের শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান সমাজের মানুষ। তাঁর মননের সঙ্গী ছিল সুফি সাধনার ঐতিহ্য। সা বিরিদ খাঁ বেশ কয়েকটি গ্রন্থের রচয়িতা। তবে কোনোটিরই সম্পূর্ণ অংশ পাওয়া যায়নি। ‘বিদ্যাসুন্দর’,’রসুলবিজয় এবং হানিফা’ ও ‘কয়রাপরী’ নামে তাঁর তিনটি কাব্যের খন্ডিত পুথি পাওয়া গিয়েছে।

‘বিদ্যাসুন্দর’ ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রচিত একটি রোমান্টিক প্রণয়কাব্য। ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্যের কাহিনী কালিকামঙ্গলের অন্তর্গত এবং রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র-সহ অনেক কবি একই কাহিনী ভিত্তিক কাব্যের রূপ দিয়েছেন। সা বিরিদ খাঁ-র কাব্যের কাহিনী মূলত মানবরসের লৌকিক কাব্য হলেও, দেবী কালীর মাহাত্ম্য প্রকাশই এই কাব্যের অন্যতম উপজীব্য। কাব্যরস সৃষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য কবির ছিল না। তবে এই আখ্যানের নামধাম ও কাহিনিতে কবি সা বিরিদ খাঁ কিছু নতুনত্বের সঞ্চার ঘটাতে চেয়েছিলেন। হিন্দুর পুরাণ এবং অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ সম্পর্কে কবি ওয়াকিবহাল ছিলেন তার কিছু ইঙ্গিত মেলে এই কাব্যের পাতায় পাতায়।

কালী মাহাত্মে আবিষ্ট হয়ে তাঁর রহস্যাবৃত রূপে ভক্তি ও ভালবাসায় মগ্ন হয়েছিলেন বাংলার আরও অনেক মুসলমান কবি। নওয়াজিস খান, আলি রজা, আকবর আলি, মির্জা হুসেন আলি, মুনসি বেলায়েত হোসেন, সৈয়দ জাফর খাঁ প্রমুখ লিখেছিলেন শ্যামাসঙ্গীত। হিন্দু কবিদের তুলনায় সংখ্যায় কম হলেও, এঁদের লেখা শ্যামাসঙ্গীত এক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। উল্লেখের দাবি রাখে কবি সৈয়দ জাফরের লেখা- ‘কেন গো ধরেছ নাম দয়াময়ী তায়/…সৈয়দ জাফর তরে/ কী ধন রেখেছ ধরে/ সম্পদ দুখানি পদ হরের হৃদয়’। পাশাপাশি বলতে হয় মুনসি বেলায়েত হোসেনের গান- ‘কালী কালী বলে কালী, সহায় হইলে কালী/ নাথেরে পাইবে কালী/ ঘুচিবে এ বিরহানল’। বাংলার এই সব কবিরা ধর্মে নিষ্ঠাবান মুসলমান হয়েও কালী ভক্তি বা রসে আপ্লুত হয়ে শ্যামাসঙ্গীত রচনায় যেভাবে ব্রতী হয়েছিলেন তা এক দুর্লভ সম্প্রিতী ও সমন্বয়ের নিদর্শন।‘প্রাচীন বাঙ্গলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান’ প্রবন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন স্মৃতিচারণ করেছেন, “আমি নিজে দেখিয়াছি, ত্রিপুরাবাসী গোলমাহমুদ স্বীয় দলবল লইয়া স্ব-রচিত কালী-বিষয়ক নানা সঙ্গীত ঝিঁঝিট রাগিণীতে আসরে গাহিতেন। তাঁহার রচিত- “উন্মত্তা, ছিন্নমস্তা এ রমণী কা’র-” প্রভৃতি গানের রেশ এখনও আমার কানে বাজিতেছে। কিন্তু গোলমাহমুদকে মুসলমানেরা কখনও ‘কাফের’ বলেন নাই। তিনি স্বর্ধমনিষ্ঠ ছিলেন। সৈয়দ জাফর শাহের কালী-বিষয়ক গান অনেকেই জানেন।” এ এক আশ্চর্য সংহতি ও সমন্বয়ের গল্প!
Share.

4 Comments

  1. Amarnath Mondal on

    বাঃ! অনেক অজানা তথ‍্য। পরিশেষে… কাঁহা গয়ে ও দিন

Leave A Reply

Exit mobile version