শিকারে যেমন অনাগ্রহী ছিলেন সিনেমা-টিনেমার কথাও কোনও দিন ভাবেননি। অন্তত প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াকালীনও।বরং ডাক্তার হয়ে গৌরীপুরের গরিব প্রজাদের সেবা করার কথা ভাবতেন। প্রাথমিক শিক্ষার পরে কলকাতার হেয়ার স্কুল, প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর বিদেশে গিয়ে আরও পড়ার কথা ভেবেছিলেন কিন্তু মায়ের আপত্তিতে হয়নি। কলেজে পড়ার সময়ে শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করা ‘ইয়ং ম্যানস ড্রামাটিক ক্লাব’ থেকে ‘নূরজাহান’,‘কারাগার’, ‘প্রফুল্ল’, ‘বিবাহবিভ্রাট’ ইত্যাদি নাটক পরিচালনা ও অভিনয়ে মেতেছিলেন। ‘ষোড়শী’ নাটকে জীবানন্দের চরিত্রে অভিনয় করতেন। কারণ শিশির ভাদুড়ীও জীবানন্দের চরিত্রে অভিনয় করতেন। নাটক ছাড়াও খেলতেন ফুটবল, ক্রিকেট,ব্যাডমিন্টন, টেনিস ও বিলিয়ার্ড। বিলিয়ার্ড টুর্নামেন্টে সাহেবদের হারিয়ে একাধিক বার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলেন।

তাঁর বাবা জমিদারি দেখার দায়িত্ব নিতে বলায় বলেছিলেন, তিনি কাবুলিওয়ালা হতে পারবেন না। যারা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, তাদের থেকে তিনি টাকা চাইতে পারবেন না। ১৯২৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘অসম ব্যবস্থা পরিষদ’-এর সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর গভর্নর লরি হ্যামন্ড তাঁকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সাহেবের সেই উপহার ফিরিয়ে দিয়ে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দেন। এরপরেই সিনেমার নেশা তাঁকে পেয়ে বসে, রাজনীতি ধীরে ধীরে অনেক দূরে চলে যায়। 

তখন ‘ব্রিটিশ ডোমিনিয়নস ফিল্ম কোম্পানি’তৈরি হয়েছে ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, দেবকীকুমার বসু, নীতীশ লাহিড়ীদের হাতে। দেবকী বসুর পরিচালনায় ওঁদের প্রথম ছবি ‘পঞ্চশর’-এর শুটিং দেখতে ডাকলেন ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়। নায়ক নায়িকাকে পাশে নিয়ে বন্দুক ছুড়ছে। তিনি লক্ষ্য করলেননায়ক বন্দুকটাই ঠিক মতো ধরতে পারছেন না। না জানার ফলে ভুলটাওকারও চোখে পড়ছে না। তিনি না পেরে সেটা বলেই ফেললেন। দেবকী বসুর অনুরোধে তিনি নায়ককে দেখিয়ে দিলেন।পরিচালক ওই দৃশ্যে নায়কের জায়গায় তাঁকেই তখন অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। সেদিন প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেও সিনেমার প্রতি তাঁর আগ্রহ বেড়েই চলে। 

ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের দ্বিতীয় ছবি ‘টাকায় কি না হয়’ ছবিতে তিনি ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।তাঁর যকৃতে পাথর ধরা পড়লে চিকিৎসার কারণে যান ইউরোপে। ওখানে গিয়েই প্রথম সিনেমার স্বপ্ন দেখেন। সেখানেই ফিল্ম কোম্পানি তৈরি করার কথা ভাবতে ভাবতেএক সময় ফিল্ম মেকিং শিখতে শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ তখন ফ্রান্সে, খবর পেয়ে তাঁকে গিয়ে ধরলেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে দেখা করলেন খ্যাতনামা ক্যামেরাম্যান রোজার্সের সঙ্গে। হাতেকলমে শিখলেন সিনেমায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার, যা তখন ভারতীয় সিনেমায় অজানা। তারপর একদিন শুটিংয়ের জন্য বিস্তর আলো ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনে কলকাতায় ফিরলেন। শুরু হল ‘বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট’-এর প্রথম নির্বাক ছবি ‘অপরাধী’র কাজ। পরিচালক দেবকী বসু ও ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণগোপাল। বাংলা সিনেমায়প্রথম কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। চিত্রা টকিজ়ে ১৯৩১-এর২৮ নভেম্বরমুক্তি পাওয়া ‘অপরাধী’ প্রংশিত হয়েছিল। এর পরে নিজের কাহিনি নিয়ে আরও দুটি নির্বাক ছবি, ‘একদা’ এবং ‘নিশির ডাক’। কলকাতার গৌরীপুর হাউজ়ের একটা অংশ নিয়ে শুরু করলেন বড়ুয়া স্টুডিয়োর কাজ। সেখানে ‘একদা’র কিছু অংশ শুটিংও হয়েছিল। পঞ্চাশ বছর পরে বাংলার অবস্থা ভেবে লেখা নিজস্ব কল্পকাহিনি নিয়ে ছবি করলেন ‘বেঙ্গল নাইন্টিন এইট্টি থ্রি’। ছবি মুখ থুবড়ে পড়লো। ইতিমধ্যে সিনেমার জন্য জলের মতো টাকা খরচ করে ফেলেছেন। টাকা আসত গৌরীপুর রাজবাড়ির এসেস্ট থেকে। একদিন সেই যোগান বন্ধ হল। এস্টেটের দেওয়ান তাঁর বাবাকে সাবধান করলেন, এভাবে ছেলের সিনেমায় টাকা ওড়ানোটা ঠিক হচ্ছে না। প্রথম দিকে তাঁর বাবা নারাজ হলেও পরে ভেবে দেখেছিলেন দেওয়ানের কথাই ঠিক। কারণ তাঁর বাবা তত দিনে বুঝে গিয়েছেন, ছেলের দ্বারা আর যা-ই হোক, ব্যবসা হবে না। ফলে টাকার অভাবে একদিন বন্ধ হয়ে গেল বড়ুয়া ফিল্ম কোম্পানি। ফলে মানসিক ভাবে তিনি ভীষণভাবেই পড়লেন।

কিন্তু সব শেষ হয়েও যেন হল না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি যোগ দিলেন নিউ থিয়েটার্সে। ওই ব্যানারে তিনি প্রথম সবাক ছবি ‘রূপলেখা’ তুললেন। নায়িকা যমুনা দেবী। সেটাই ছিল যমুনা দেবীর ডেবিউ ছবি। এরপর একদিন নিজেই দেখা করলেন শরৎচন্দ্রের সঙ্গে। তাঁর ‘দেবদাস’ ছবি করতে চান। শরৎচন্দ্র নিজেই ভাবেন নি যে তাঁর সেই কাহিনি ছবি হতে পারে। দেবদাসের চরিত্রে তিনি নিজে আর পার্বতীর চরিত্রে যমুনা।কেবল প্রযুক্তি নয়, দেবদাসের দৃশ্য রচনায় এক একটি শট নিয়েওযেমন বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা তেমনিমন্তাজ, ইন্টারকাটিং, ক্লোজ়আপ ইত্যদি ব্যবহার করে নাটকীয়তা তৈরি করলেন। বাংলা সিনেমায় ‘দেবদাস’ ইতিহাস রচনা করল।

এরপর মুক্তি পেল আর এক হিট ছবি‘মুক্তি’৷ বাংলা সিনেমা দুনিয়ার প্রথম নায়িকা একটি ছবির জন্য একলাখ টাকা পারিশ্রমিক চেয়েছিলেন এবং প্রযোজক বিনা দ্বিধায় তাতে রাজি হন। তাঁর আগে কোনও ভারতীয় ছবির অভিনেত্রী এই পরিমাণ পারিশ্রমিক পাননি। শুধুঅবিভক্ত বাংলা নয়, গোটা দেশ জুড়ে দর্শকদের সপ্রশংস উচ্ছ্বাস। ‘মুক্তি’ই প্রথম ছবি, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছিল। এর জন্য সানন্দ অনুমতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবির নামকরণও তিনিই করেছিলেন। আউটডোর হয়েছিল গৌরীপুরের জঙ্গলে। যেখানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর প্রিয় হাতি জঙ্গবাহাদুরকে।১৪টি বাংলা ও ৭টি হিন্দি ছবি করেছিলেন। সিনেমার সবক্ষেত্রে সফল হলেও বাংলা সিনেমার প্রিন্স ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারেন নি। অন্তরায় তাঁর রাজরক্তের মেজাজ। তাই ফেলে আসা জমিদারিতেও ফিরে যান নি। 
Share.

2 Comments

Leave A Reply

Exit mobile version