আইপিসি বা ভারতীয় দণ্ডবিধি (Indian Penal Code) এবং সিআরপিসি বা ফৌজদারি কার্যবিধি (Criminal Procedure Code) অনুযায়ী পুলিশ কোনো ঘটনাস্থল থেকে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য বা তাদের হটিয়ে দিতে “লাঠিচার্জ” করতে পারে। তবে বিপিআরডি (Bureau of Police Research and Development) নিয়মানুসারে “লাঠিচার্জ” এর লক্ষ্য কেবলমাত্র জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা, তাদের উপর আক্রমণ করা নয়। কিন্তু সম্প্রতি আমরা এ রাজ্যে বেশ কয়েকটি ঘটনায় দেখলাম পুলিশ সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ বা আন্দোলন দমন করতে বিশেষ করে চাকরিহারা শিক্ষকদের আন্দোলনকে প্রতিহত করতে কেবলমাত্র লাঠিচার্জ নয় শিক্ষকদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ চালিয়েছে, লাথি মেরেছে, লাঠি দিয়ে মেরে শিক্ষকদের হাড় ভেঙে দিয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের উপর ব্রিটিশ পুলিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে যে বর্বরোচিত আক্রমণ করতো, স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও “লাঠিচার্জ” স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য নিষ্ঠুর এবং মর্মান্তিকভাবেই প্রয়োগ হয়ে চলেছে, অর্থাৎ পুলিশি বর্বরতা থেকে এখনও আমাদের রেহাই মেলেনি বরং পুলিশের অত্যাচারের যন্ত্রণায় কাতরাতে হচ্ছে। তার মানে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে, সাধারণ মানুষের দাবী দাওয়া বা প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করে দেওয়া এবং বিক্ষোভ দমন করার জন্য “লাঠিচার্জ” একটি প্রচলিত উপায়ে পরিণত হয়েছে।
প্রশ্ন, বিক্ষোভ বা সাধারণ মানুষের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন প্রতিহত করার আইনি বিধান কী”লাঠিচার্জ”? সাধারণভাবে বলা হয় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে বা সরকারি ক্ষয় ক্ষতি রোধ করার জন্য যদি রাষ্ট্র পুলিশকে নির্দেশ দেয়, তাহলে তারা আন্দোলনকারীদের দমন করা জন্য ফৌজদারি দমনের ধারা ১৪৪ প্রয়োগ করতে পারে। (পুলিশি দমন-পীড়নের আইপিসি ধারা ১৪০-এ অন্তর্ভুক্ত)। কিন্তু তার আগে পুলিশকে আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ শান্ত করতে বলতে হবে, তাদের সতর্ক করতে হবে, এরপরও যদি আন্দোলনকারীরা শান্ত না হয়, দমে না যায়, তাহলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে পারে। অবশ্যই তা আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ বিক্ষোভের মাত্রা বুঝে। এতেও যদি আন্দোলনকারীদের ক্ষোভ বিক্ষোভের মাত্রা বেড়েই চলে এবং তা অন্য মাত্রা ধারণ করে, তাহলে পুলিশ তাদের উপর “লাঠিচার্জ” করতে পারে কিন্তু তা কোনোভাবেই প্রতিশোধস্পৃহা বা প্রাণঘাতী নয়। সাধারণত, একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাই পুলিশকর্মীদের “লাঠিচার্জ” করার নির্দেশ দিতে পারেন। কিন্তু লাঠিচার্জের সময় পুলিশকে আঘাতজনিত বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কোনোভাবেই লাঠির আঘাত কারও মাথায় যেন না লাগে।
অন্যদিকে সল্টলেকে চাকরিহারা শিক্ষকদের উপর বিধাননগর পুলিশের লাঠিচার্জ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য উঠে এল পুলিশকর্তাদের কথায়। লাঠিচার্জ হল কেন? এই প্রশ্নে কখনও ভুল স্বীকার করতে শোনা গেল কলকাতা পুলিশের অফিসারকে। কখনও বাধ্য হয়ে লাঠিচার্জ এমন কথাও শোনা গেল। যখন প্রশ্ন উঠলো লাঠিচার্জটা কি দরকার ছিল? ডেপুটি কমিশনার পি চৌধুরী বললেন, কলকাতা পুলিশ ভুল করেছে। চাকরিহারা আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছিল বিধাননগর কমিশনারেটের পুলিশ। আবার সাংবাদিক বৈঠকে আরেক ধরনের তত্ত্ব খাড়া করেন এডিজি দক্ষিণবঙ্গ সুপ্রতিম সরকার। তিনি বলেন, ‘প্রতিবাদ করার অধিকার যদি আন্দোলনকারীদের থেকে থাকে, সারাদিন কাজ করার পরে নিরাপদে বাড়ি ফিরে পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার অধিকারও ছিল সরকারী কর্মীদের। আমরা নিরাপদে তাঁদের বের করেছি এবং এই বার করার প্রক্রিয়ায় যেটুকু বলপ্রয়োগ করতে হয়েছে সেটুকু হয়েছে এবং সেটা স্বীকার করতে আমাদের কোনও দ্বিধা নেই।’ অর্থাৎ পুলিশি অ্যাকশনে লাঠিচার্জ-গলাধাক্কা-কিল-চড়- বাদ থাকছে না কিছুই। চাকরিহারা শিক্ষকদের হঠাতে পুলিশের লাঠিচার্জ রক্তারক্তি পরিস্থিতি তৈরি করছে। কেবল পুলিশ নয়, তৃণমূল নেতা সব্যসাচী দত্তর শাসানিদেওয়ার পর তাঁর অনুগামীদের হাতে মারও জুটেছিল শিক্ষকদের। আর রাতে হকের চাকরি চাওয়ার দাবি নিয়ে জুটল পুলিশের লাঠি-ঘাড়ধাক্কা।
আন্দোলনকারী শিক্ষকরা কেউ জানিয়েছেন, পুলিশ মেরে পা ভেঙে দিয়েছে। এমনকী মহিলা শিক্ষক জানিয়েছেন, ‘পুরুষ পুলিশ আমাদের মেরেছে’। এ যেন পুলিশের ‘শিক্ষক শাসন’। যেখানে পুলিশি অ্যাকশনে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছেন শিক্ষকরা। কোথাও পুলিশি পেশিশক্তিতে শিক্ষকের জামা ছিঁড়েছে। কিন্তু তাতেও এওখনও দমানো যায়নি চাকরিহারা আন্দোলনকারীদের। পুলিশ শুধু শিক্ষকদের নাজেহাল করেই ছাড়েনি। মানুষ গড়ার কারিগরেরা মানুষ গড়তে গিয়ে ছাত্রদের শাসন করেছেন। অবশেষে পুলিশের হাতের লাঠি শিক্ষকদের পিঠে উঠছে। শিক্ষকদের উপর পুলিশের এই অত্যাচার শুধু শিক্ষক সমাজকে নয়, গোটা জাতিকেই অপমানিত করেছে। এই পুলিশরা নিশ্চয় ভুলে গেছে যে তারাও একদিন এই শিক্ষকের কাছে গিয়েছিলেন মানুষ হতে। শিক্ষকদের দৌলতেই আজ হয়ত তারা এখানে আসতে পেরেছেন। দুর্ভাগ্য ন্যায্য চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবি জানানোয় শিক্ষকদের পুলিশের লাঠি খেতে হচ্ছে। আমাদের পুলিশ ব্যবস্থাই কি এমন, নাকি করা হয়েছে?