মেঝের উপর ছড়ানো ৫০০ আর ২ হাজার টাকার বান্ডিলের স্তূপ- টেলিভিশনের পর্দায় এই ছবি দেখেই আমাদের চোখ কপালে উঠেছে। ওঠারই কথা, কারণ গভীর জঙ্গলের ভিতর কোনও গুহায় নয়, শহর কলকাতার বুকে দামী অ্যাপার্টমেন্টে ঘরবন্দি করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা, কেজি কেজি সোনা,জমি, বাড়ি,ফ্ল্যাটের দলিল। অনেকেই বলেছেন,ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন কথাটি আর বলা যাবে না। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে প্রথমে ২২ কোটি, তারপর ২৮ কোটি, সবমিলিয়ে ৫০ কোটি, তার উপর কোটি পাঁচেকের সোনা ও গয়না উদ্ধার হওয়াতে কেউ কেউ বলেছেন, ওনাকে দেখে কিন্তু বোঝা যেত না। অর্থাৎ পার্থ-র ১২৩ কেজি ওজনের চেহারা, মুখচ্ছবি, চলাফেরা, কথাবার্তায় আমরা বুঝিনি যে ওঁরও বান্ধবী থাকতে পারে; তাও আবার একজন নয় একাধিক।

মডেল ও সিনেমার নায়িকা অর্পিতা ৬৮ বছরের পার্থর বান্ধবী, এছাড়াও আছেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ-র যে একাধিক বান্ধবী থাকতে পারে তা আমরা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দেখে বুঝিনি। বেহালা, ঠাকুরপুকুরও নাকতলা এলাকায় প্রায় ২০০টি ছোট-বড় পুজো, এইসব পুজোর প্রায় সবকটির কমিটিতেই ছিলেন পার্থ। কোনওটির সভাপতির পদে, কোনটির সম্পাদক পদে এমনকি উপদেষ্টা মন্ডলীর অন্যতম হিসেবেও থাকতেন তিনি।শুধু ক্লাবের পুজো নয়, বিভিন্ন নামকরা আবাসিক পুজোতেও দেখা যেত পার্থকে। আমরা আগে বুঝিনি একই পার্থ কি করে এতগুলি পুজো কমিটির মাথায় থাকতে পারেন। কেবল আমরা কেন বেহালা, ঠাকুরপুকুর ও নাকতলা এলাকার ২০০টি পুজো কমিটির লোকজনও বোঝেন নি, যাদের খুব কাছের ও প্রিয় মানুষ ছিলেন পার্থদা।

আমরা সত্যিই আগে বুঝিনি তাই পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে আরও কত কোটি টাকার হদিশ মিলবে অথবা মিলবে না তা আমাদের জানানেই। তবে ফুটো পকেটের জামা গায়ে স্বপ্ন দেখলেও তাতে কোটি কোটি টাকা যে ভেসে উঠবে না তা জেনে গিয়েছি। পাশাপাশি ছবিতে দেখতে দেখতে কোটি কোটি টাকাও যেন জল ভাত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এর একতু ধারেই অন্য একতা ছবি রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজেও জীবন্ত হয়ে আছে- শামিয়ানার নীচে আন্দোলনরত কয়েকশ চাকরিপ্রার্থী নারী পুরুষ আজও একটাই আশায় অবস্থান করে আছেন, “একদিন সুবিচার অবশ্যই পাওয়া যাবে। একদিন হকের চাকরি পাওয়া যাবে”। এই ছবিটা কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে পার্থ-র বান্ধবিকে নিয়ে খিল্লিতে একটুকু জায়গা পায়নি।

কারন,বাংলার সরকারের অর্থ ভাণ্ডারে যতই টানাটানি থাকুক না কেন, শিল্পহীন বাংলার অর্থনীতি যতই দুর্বল হোক না কেন, বাংলার রাজনীতিক আর তাঁর বান্ধবীর অর্থনীতিতে মন্দার কোনও ছায়া পড়েনি। আমরা আগে সে কথা বুঝতে পারিনি। তাই তাঁদের টাকানীতি ফুলেফেঁপে উঠেছে। তদুপরি আরেকটা জরুরি কথা সেটিও আমরা আগে বুঝতে পারিনি, অথচ আড়ালে-আবডালে কান পাতলে শোনা যায়, রাজনীতিক, শিল্পপতিরা ঘরে টাকা রাখেন কম, বেশির ভাগটাই দেশে-বিদেশে পাচার করে দেন, বিনিয়োগ করেন। পার্থ বা তাঁর বান্ধবীরা সেরকম কিছু করেছেন কিনা, তা যদি তদন্ত আরো এগোয় টের পাওয়া যাবে? যাই হোক আমরা কিন্তু আগে বুঝতে পারিনি।

আমরা বুঝতে পারিনি অর্পিতার ফ্ল্যাটে টাকার পাহাড় জমছে, অন্যদিকে কলকাতাতে গান্ধী মূর্তির সামনে বিক্ষোভকারীরা পরীক্ষা দিয়ে পাস করে যোগ্যতামান পেরোনোর পরেও চাকরি পাননি। রাস্তার ধারে বসে তাঁরা লড়ে যান। কারো সন্তান জন্মের আটদিন পরে মারা গেছেন, কেউ স্বামী-বাচ্চাকে নিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, কেউ ক্যানসারের মতো রোগকে সঙ্গী করে দিনের পর দিন বিক্ষোভ দেখিয়ে গিয়েছেন। শুধুমাত্রটাকার জোর থাকায় তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে অন্যরা চাকরি পেয়ে গিয়েছেন, মন্ত্রী ও তার বান্ধবীর ঘরে ৫০০, ২ হাজার টাকার বান্ডিল ঢুকেছে, আর তাঁরা রাস্তার পাশে প্ল্যাকার্ড ধরে বসে আছেন একদিন ন্যায় পাবেন, এই আশায়। এই দুই ছবির পরতে পরতে যে অন্যায় রয়েছে, যে রমরমা দুর্নীতির রয়েছে আমরা তা বুঝতে পারিনি।

আমরা পার্থ-র বান্ধবি আর টাকা গোনার মেশিন নিয়ে খিল্লি করে চলেছি, তারকা সমাজ থেকে ইউটিউবার কেউই বাকি নেই সেই খিল্লিতে। একদিকে আমাদের হাসির রোলটি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মতো চার-ছয়ের বন্যায় যখন ভাসছে তখনও রোদে পুড়ে, জলে ভিজে দিনরাত অনশন চালিয়ে, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলেছেন বিক্ষোভরত চাকরিপ্রার্থীরা। তারকা সমাজ থেকে ইউটিউবার সবাই হাসির রোল তুলতে চাইছেন পার্থ আর তাঁর বান্ধবীকে নিয়ে। টালিগঞ্জ বনাম বেলঘরিয়ায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতবে কে? সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়েও চরম খিল্লি। এদিকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও ধুঁকতে হচ্ছে বাংলার চাকরীপ্রার্থীদের, সেই প্রেক্ষিতেকোনও ক্ষোভ নেই।নমূল কাণ্ডারিরাই ব্রাত্য হয়ে পড়ে আছেন রাস্তার ধারে। যোগ্যতার কারণে যাদের শিক্ষক হওয়ার কথাছিল তারা ধর্না মঞ্চে অবস্থানকরী পরিচয়ে ৫০০ দিন কাটিয়ে দিলেন। আর আমরা আগে বুঝিনি বলে খিল্লি মারছি।

দুর্নীতির এই উলঙ্গ ছবি বাংলা আগে দেখেনি। বাঙালিও বোঝেনি দুর্নীতির বিরাট আকার। বাম জমানাতেও পঞ্চায়েত সদস্য হওয়ার পরই কী করে বিশাল বাড়ি করে ফেলা যায়, তা তো আমরা এই বাংলার গ্রামেগঞ্জে দেখেছি। সিন্ডিকেট, তোলাবাজি-সহ হাজারো উপায়ে দলের নেতারা কীরকম ভাবে ফুলেফেঁপে উঠেছেন, সেটাও দেখেছি। পাঁচ বছরের মধ্যে সাংসদ-বিধায়কদের সম্পত্তি কীরকম ভাবে বেড়ে যায়, সেটাও তো আমাদের দেখতে হয়েছে। কার বাড়ি হবে, কে জমি কিনবে, কোন পুকুর ভরাট হবে, কোথায় পাঁচিল উঠবে সবই ঠিক করেছে সিপিএমের ক্লাব। আর আজ রাতভর মেশিনে টাকার বান্ডিল গুনতে হচ্ছে বলে গুহ্যদ্বার শুরশুর করছে। রাজনীতিকদের কাছে দুর্নীতির টাকা থাকবে নাতো কি আমার আপনার পকেটে থাকবে। আমাদের বিরাট প্রতিবাদ কেবলই দুর্নীতিগ্রস্তদেরই জিতিয়ে আনছে পাঁচ বছর অন্তর। তা না হলে সারদা কেলেঙ্কারির পর পার্থ-রা জিতে ফিরে আসতে পারে কি? তিন বছর জেলের ভাত খেয়ে, মুখ্যমন্ত্রীকে চোর, জোচ্চর বলে বেরিয়ে এসে তাঁরই মুখপাত্র হওয়া যায় কি? ফেসবুকে খিল্লি মারা যায়, একজনের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বাকি সবাইকে সাধু প্রতিপন্ন করা যায়না।
Share.

3 Comments

  1. sudipta sanyal on

    তুমুল লিখেছ। ভোট আসলে আমরা আবার মুকুট পরিয়ে দেবো আর হতাশায় পোতিবাদ শুরু করবো বছর পেরোতেই

  2. দারুণ। এক্কেবারে চাবুক। কিন্তু আমাদের বিবেক তো পাথরের, সেখানে চাবুকের দাগ পড়বে না। আমরা রক্ত মাংসের হলে কবেই চিতাবাঘ হয়ে যেতাম।

  3. mala chakrabarty on

    সবথেকে ভয়াবহ সত্যি হল ওই সব দলগত ব্যাপার আর নেই। যেখানে ক্ষমতা সেখানেই দুর্নীতি। আজ সবুজে আছে কালকে গরুয়া ক্ষমতায় এলে এই মানুষগুলো গেরুয়ায় চলে যাবে। ভোটের আগে তো দেখলাম দল বদলের সে কি হিড়িক। আবার ফেরত আসাও দেখলাম । আসল কথা হল, যেখানে করেকম্মে খাওয়া যাবে এনারা সেখানেই থাকবেন। আর আমরাও হিসেব করে দেখব কি সে আমাদের ব্যক্তিস্বার্থ বজায় থাকবে। সমাজের সামগ্রিক মঙ্গলের কথা আমরা কেউ ভাবি না। আমিও তাই। যে দল বলবে বকেয়া ডি. এ দেবে ক্ষমতায় এলে তাকেই ভোট দেবো। সে দলের মুখ পার্থ চট্টোপাধ্যায় হলেও আমার বয়েই গেল।

Leave A Reply

Exit mobile version