পারমিতা মুখোপাধ্যায়

— কি রে তোর হল? হাতে তো আর খুব বেশি দিন নেই। এ দিককার সব কিছু সামলে নে। তারপর গোছগাছ শুরু করতে হবে। ও দিকে যা অবস্থা, কী জানি কী হয়! তবু যেতে তো একবার হবেই! ও স্বরা, কী কী নিতে হবে এবারে এক্সট্রা, তার একটা লিস্ট করে নে মা।
— আচ্ছা মা, সব কিছু আমাকে আমাকে কেন বলো! এ বারে আমার কী অবস্থা তুমি জানো না! সেই যে পুজো নিয়ে ফিরলাম, তারপর থেকে বেশি রাত কাটল না ঘুমিয়ে। তারপর শুরু হল আর এক ঝামেলা— অন লাইন ক্লাস। বিশ্বকর্মা কাকুকে নিয়ে আমি আর পারি না। এ সব ইন্টারনেট-ফেটের বিষয়টা কাকু একদম বুঝতে পারে না। যত্ত ঝামেলা হয়েছে আমার। আর আছে তোমার এই সব অপদার্থ মর্ত্যবাসী। কিস্যু পারে না। কেবল মুখেন মারিতং জগৎ। কেন যাও বলো তো প্রতিবার!
— অমন করে বলে না মা। একটু যেতে হয়। নইলে ওদের মন খারাপ হয় না!
— ছাই হয়! তুমি জানো আমার কী অবস্থা! একবার বলছে পরীক্ষা হবে, একবার বলছে হবে না। একবার বলছে এমনিই ক্লাসে তুলে দেবে। আবার বলছে কেউ চাইলে পরীক্ষা দিতে পারে। এই করে করে দু’মাস কাটিয়ে দিল। তারপরে যেই দশ-বারোর রেজাল্ট বেরোল অমনি লোকে হাঁই হাঁই করে উঠল, এ বাবা ফুল মার্কস দিয়ে দিল, ফুল মার্কস দিয়ে দিল! আরে তো কী করবে? ধরো যদি সবাইকে ৯০ কি ৮০ শতাংশ নম্বর দিত, তখন বলত না, আমি বাবা ভাল ছেলে ১০০ই পেতাম! ওরা ইচ্ছে করে পরীক্ষা না নিয়ে আমার কেরিয়ারটা নষ্ট করে দিল! যত্তসব।
— আচ্ছা, সে তো মিটেই গেছে। এখন মাথা ঠান্ডা কর।
—কী মিটে গেছে? কী মিটে গেছে? তুমি কোনও কিছু খবর রাখ? কী এক জাতীয় শিক্ষা নীতি আসছে। এক মাসের মধ্যেই নাকি ক্লাস শুরু হবে! বলি, ছাত্রছাত্রীদের কথা ভাববে কে? আর আমার শিক্ষকরা! তাঁরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে! তাঁরা মানুষ নয়! পঞ্চাশের উপর যাঁদের বয়স, তাঁরা সংক্রামিত হলে, কে রক্ষা করবে! শুধু তাই কেন, এই তো সে দিন মাত্র ৩৮ বছরের এক কলেজ শিক্ষকও মারা গেলেন মর্ত্যে। এ সব কী হচ্ছে! যমজেঠুও আমাকে বকবে। ওখানে ওরা সামাল দিতে পারছে না। সব দায় যেন আমার!
— তা কী করবে! সকলকেই তো কাজে বেরতে হচ্ছে একমাত্র শিক্ষকরাই ঘরে বসে মাইনে পাচ্ছে। দেখছিস না সোশ্যাল মিডিয়ায় ওদের কেমন তুলোধোনা করছে লোক।
— বাজে বকো না তো, তুমি মা ভীষণ লোকের কথায় নাচো! তোমরা সকলে মিলে যে কেন আমার পিছনে লাগো! যেমন তুমি, তেমন তোমার ছেলে মেয়েরা! ঘরে বসে থাকবে না তো কী স্কুলে, কলেজে গিয়ে বেগুন বেচবে? তাও তো দিচ্ছে, মিড-ডে মিলের চাল আলু তো দিয়ে এসেছে গিয়ে! আর কী করবে! যার যা কাজ! আমি কি তোমার লক্ষ্মীর ভাঁড়ারে উঁকি দিতে যাই! তা ছাড়া, আমি তো বলেছিই হ্যাঁ ব্যাঙ্কের মানুষগুলোর খুব কষ্ট— হ্যাটস অফ টু দেম।
— আহা শিক্ষকেরা তো ঘরে বসেই একটু আধটু পড়িয়ে দিতে পারে। সে তো এমন হাতি ঘোড়া মারা কোনও কাজ না!
— মা… তুমি যাও তো এখান থেকে। কিচ্ছু জানো না বোঝো না। কেবল আমাকে রাগিয়ে দাও! ক্লাস করছে যারা পারছে। তার মধ্যে তো আবার সরকারি বেসরকারি আছে। সরকারি স্কুলে যারা পড়ে আজকাল খোঁজ রাখ তাদের! তুমি তো নাকি জগজ্জননী! জানো ক’টা লোকের ঘরে মোবাইল আছে! তাও স্মার্ট! সবাই তো তোমার ময়ূরবাহনের তো স্মার্ট নয় মা! তারা খেতে পর্যন্ত পায় না। লক্ষ্মীর তো আবার নানা বাছ বিচার। কী যে করে, কেন যে করে, ওর কাছে যে কে ভাল, কে খারাপ আমি বুঝতেই পারি না।
— সে তুমিই মা কী এমন করছ! এই তো আমি খবর পেলাম, পুরুলিয়ার এক কলেজ শিক্ষক অনলাইনে ক্লাস নিতে চান। অনেক কষ্ট করে জনা দশেক ছাত্রকে তিনি ফোনে যোগাযোগ করতে পারলেন। জটিল মিটিং অ্যাপের বদলে তিনি বললেন, তোমাদের তো ফেসবুক আছেই, সেখানে লাইভে ক্লাস নিয়ে নেব। তোমরা তা হলে পরেও সেটা বাজিয়ে বাজিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে, উত্তর লিখতে পারবে। সুবিধা হবে। কমেন্টে প্রশ্ন করলে আমি সময় মতো উত্তরও দিয়ে দেব। ও বাবা! সে পুরুলিয়ার ছাত্রীরা বলে, না স্যর। বাবা মা ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুললে বকবে। আমাদের ফেসবুক করা বারন!
— ওঃ তুমি তা হলে সব জানো। তারপরও আমাকে খোঁচাতে এসেছে!
— কেন বলব না! তুমি সব সময় লক্ষ্মীকে খোঁচাবে…তা তুমি কী শিক্ষাটা ছড়াতে পেরেছে শুনি! তারা মেয়েদের এমন অবজ্ঞা করে কেন! কী করলে তা হলে তুমি এত বছর ধরে। বছর বছর যে মাঘ মাসে যাচ্ছ, কী উলুবনে মুক্তো ছড়াচ্ছ!
— ও! সে দোষ আমার?
— শোনো তোমার সঙ্গে ঝগড়া করার সময় আমার নেই। হেরুর তাড়া আছে। মুম্বইয়ের অবস্থা ভাল না। একে সংক্রমণ, তায় জলস্ফীতি, কী জানি এ বার কী হয়! হেরুকে সব গুছিয়ে দিতে হবে। কী খাবে এ বছর ছেলেটা সেটা নিয়েই আমি ভাবছি!
(ঘরে গজানন হেরম্বের প্রবেশ)
— মা, ও মা! একটা কথা বল তো, আমরা আসলে কী? মানে আমরা ভারতীয়! না বাঙালি! না মারাঠি!
— কেন বাবা, অমন করে কেন বলছিস?
— না মানে একটা প্রশ্ন মনে খটকা দিচ্ছে মা— শুধু প্যান্ডেল প্যান্ডেল, তোর মন্দির নাই দুগ্গি! মা আমরা কি মন্দির পাব না, পাব না আমরা মন্দির!
কি রে স্বরা বল না। শুধু বাঙালি বলে, মারাঠি বলে! তোর নাকি আবার কী সব ঝামেলা পাকছে! কী সব মাতৃভাষা, এক দেশ এক ভাষার গোলমাল!
— দাদা, আমাকে আর কিছু জিগেস করিস না। শিক্ষানীতির বিষয়টা আমি তোকে বিকেলে বলছি, আমিও ওটা নিয়ে ভাবছি। তোর সঙ্গে কথা বলা জরুরি। আমার আর ভাল লাগে না। এক দিন আমি সব ছেড়ে দিয়ে অসুর মামার বাড়ির চলে যাব।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version