ঝগড়া করেনি এমন মানুষ কি আছে? রাস্তাঘাটে, হাটেবাজারে, অফিস আদালতে, মাঠে ময়দানে ঝগড়া হয়ে থাকে। তা এই কিছুক্ষণের ঝগড়ার মধ্যে থাকে দীর্ঘদিনের মেধা, পরিশ্রম, হোমওয়ার্ক ও রণকৌশল। বিভিন্ন ধরনের লোক বিভিন্ন রকমের ঝগড়া করে। অনেকে যেমন গায়ে পড়ে ঝগড়া করে তেমনই অনেকে গায়ে টেনে ঝগড়া করে।  

ঝগড়ুটে প্রধানত দুই প্রকার- বুদ্ধিজীবী ঝগড়ুটে ও শ্রমজীবী ঝগড়ুটে। বুদ্ধিজীবী ঝগড়ুটে ঝগড়ার সময় কানে হেডফোন গুঁজে রাখে। ঘন্টাখানেক পর “কী বললি?” বলে প্রতিদ্বন্দ্বী কে আরো একঘন্টা বলার সুযোগ করে দেয়। তারপর প্রতিদ্বন্দ্বীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বুঝলে ভালো না হলে আবার কানে হেডফোন গোঁজে।  

শ্রমজীবী ঝগড়ুটে প্রতি ঝগড়াকে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ বলে মনে করে। আর জেতাটাকে অভ্যাসে পরিনত করে। এরফলে শরীরে বিপি, সুগার, সোডিয়াম, পটাশিয়ামের ভারসাম্য বদলের কোনও পরোয়া না করে ঝগড়া করে। শ্রমজীবী ঝগড়ুটে আবার অনেক প্রকার হয়ে থাকে। যেমন, গতিশীল ঝগড়ুটে, প্রথম থেকেই আক্রমণ। গলার চড়া আওয়াজ ও একনাগাড়ে দ্রুত কথা বলা এই রণকৌশলেই শত্রুপক্ষকে কুপকাত করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বীর কোনও কথা বলতে দেওয়া বা তাঁদের কোনও কথা শোনার কোনও আগ্রহ তাঁদের মধ্যে থাকে না। দ্রুত ম্যাচ জেতার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁরা মাঠে নামেন।

সৃজনশীল ঝগড়ুটে- এক্ষেত্রে ঝগরুটেরা শুধু ঝগড়া করেন না। পারফর্ম করেন। পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী গলার স্বরের পরিবর্তন করেন। ছড়া কাটেন। প্রবাদবাক্য আওড়ান। বিভিন্ন সিনেমার ডায়লগ বলে থাকেন। এরপর শারীরিক ভাষারও প্রয়োগ করেন। কখনো চোখের জল কখনো দাঁত খিঁচানো কখনো এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে হাত পায়ের বিভিন্ন মুদ্রা সহযোগে নৃত্য করে থাকেন। অনেক সময় অসুস্থ বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অভিনয় করেন। এই ঝগড়ায় দর্শকশ্রোতারা অনেক বিনোদন পেয়ে থাকেন।    

প্রাকটিকাল ঝগড়ুটে- ঝগড়া করার সময় যা বলেন অথবা প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে দুই, তিন, চার, পাঁচ অক্ষর যা শোনেন পরে তা আর মনে রাখেন না। ঝগড়ার সাথে সাথে যত রাগ, অভিমান, ক্ষোভ, দুঃখ সব বন্যার স্রোতের মতো ভেসে চলে যায়। ঝগড়ার শেষে প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক হয়ে যান।

থিওরিটিক্যাল ঝগড়ুটে- এই ধরণের ঝগড়ুটেরা ঝগড়াটাকে একটা সাধনা মনে করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী ঝগড়ার সময়ে যে যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো নোট করে রাখেন। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বলতা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু করেন বিভিন্ন সোর্সের মারফত। তারপর আবার ঝগড়া করার অজুহাত খোঁজেন নতুন যোগাড় করা অস্ত্র ব্যবহার করার জন্য। এই ধরণের ঝগড়ুটেরা একটা ঝগড়াকে কয়েক বছর এমনকী কয়েক জন্ম চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।  

একমুখী ঝগড়ুটে- এই ধরনের ঝগড়ুটেরা যার সাথে ঝগড়া শুধু তাঁর সাথেই সীমাবদ্ধ রাখেন। বাকিদের সাথে স্বাভাবিক আচরণ করেন।

বহুমুখী ঝগড়ুটে- এরা সব যুদ্ধকেই বিশ্বযুদ্ধে মনে করেন। অর্থাৎ যার সাথে ঝগড়া তাঁকে যারা সমর্থন করলো তাঁরাও শত্রুপক্ষের আওতায় চলে যায়। আর শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু সেই নীতিতে একটা ন্যাটো বাহিনী গঠন করে দলবদ্ধ ভাবে ঝগড়া করার জন্য।

দূরদর্শী ঝগড়ুটে- এই ধরণের ঝগড়ুটেরা আগে থেকেই ধরে নেন তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, সহকর্মী এমনকী বাসে-ট্রেনে পাশে বসে থাকা সহযাত্রীর সাথে ঝগড়া হবে। তাই আগে থেকেই তথ্য সংগ্রহ করে থাকেন ঘনিষ্ঠদের কাছ থেকে। যেমন হবু প্রতিদ্বন্দ্বী পরীক্ষায় ফেল করেছে কিনা? কোনও লটরপটর ছিলো বা আছে কিনা? কোনও কেস খেয়েছিলো কিনা? কোনও পাওয়াদার বাড়িতে আসে কিনা? অফিসে হ্যাটা হন কিনা? এমনকি বাসে-ট্রেনে সফরের সময়ে পাশে বসে থাকা সহযাত্রী টিকিট কাটলো কিনা? কার দিকে কীভাবে তাকালো? তাঁর হাত কোথায় আছে ইত্যাদি। এই কাজ করতে গিয়ে নিজের সময়, অর্থ, শ্রম সব জলাঞ্জলি গেলেও পরোয়া নেই।  

তৎকাল ঝগড়ুটে- এই ধরণের ঝগড়ুটেরা হঠাৎ করে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন। অনেক সময়ে অন্যের ঝগড়ায় সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। হাতে যুতসই তথ্য না থাকলে কাল্পনিক তথ্য ব্যবহার করেন। এরা নিজেদের প্রতিবাদী বলে থাকেন। ঝগড়ায় জিতলে ভালো না হলে আক্রান্ত প্রতিবাদীর তত্ত্ব নিয়ে আসেন।    

একতরফা ঝগড়ুটে- এদের ঝগড়া করার কারণ লাগে না। সিরিয়ালে কোনও চরিত্র হেনস্তা হলে। প্যালেস্তাইনে বোমা বর্ষণ হলে। পুলিশ কোনও আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করলে নিজেকে আক্রান্তের জায়গায় বসিয়ে সামনের মানুষটিকে অত্যাচারীর আসনে এনে ঝগড়া শুরু করে। সারাদিন খেতে না পেলেও ক্ষতি নেই তবে সারাদিনে ঝগড়া না করলে ভাত হজম হয় না

সাইলেন্ট ঝগড়ুটে- দেখে মনে হয় ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানেন না। প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে দৃশ্যত দেশ গোল খাওয়া হেরো পার্টি। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী ঢিলের বদলে মনে মনে পাটকেল মারেন। দু অক্ষরের পালটা পাঁচ অক্ষর দেন। লোকের কাছে সহানুভূতি কুড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী কে সমাজে ভিলেন বানান।

ডিপলোম্যাট ঝগড়ুটে- ঝগড়ুটেদের মধ্যে এরা সবচাইতে বিপজ্জনক। এরা প্রতিদ্বন্দ্বীকে এমন কথা বলবেন যা তাঁর মাথায় ঢুকবে না। যেমন কলতলার ঝগড়ায় প্লেটো না নেলসন ম্যান্ডেলার কোট তুলে ধরেন। মাছের বাজারে ঝগড়া হলে হিটলারের সাথে নেতাজির সাক্ষাৎ-এর প্রসঙ্গ টেনে আনেন। অবাঙালিদের কাছে তিনি বাংলাপক্ষ। ভেতো বাঙালির কাছে মিরজা গালিফ বা আইনস্টাইন কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বী পগার পাড়।

সিক্রেট ঝগড়ুটে- শ্রমজীবী ঝগড়ুটেদের মধ্যে এরা বুদ্ধিজীবী। নিজেরা কারো সাথে ঝগড়া করেন না আউটসোর্স করেন। প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে যারা তাঁদের প্রভাবিত করেন। তথ্য সরবরাহ করেন।  

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version