(গতকালের পর)

কৈরেমাতুল্লা খাঁ, শান্তাপ্রসাদ, কন্ঠেমহারাজ, রবিশংকর, গিরিজাদেবী, আলি আকবর খাঁ, আশু কবিরাজ, আমির খাঁ সবাই এই বেনারসে পাঁড়ে ঘাটের শিবমন্দিরে বা দশাশ্বমেধ ঘাটে অনুষ্ঠান করেছেন রাতের পর রাত। আমার মায়ের বাড়ি পাঁড়ে ঘাট দেবনাথপুরায়। আর ভি কাটরা পোস্ট অফিস, বেনারসে। বাগানের বেলগাছটার পাশে ছিল শিবের ঘর। সেখানে ১০০টা বৃহৎ, মাঝারি বড়ো, মাঝারি, ছোট, ক্ষুদে সব মিলিয়ে ১০০টা শিবলিঙ্গ। মায়ের জ্যাঠামশাইকে ডাকতাম বড়োদাদু, আমাকে বড়োই ভালবাসতেন। সংষ্কৃত পন্ডিত বীরেশ্বর চক্রবর্তী পান্ডিত্যে হয়েছিলেন শাস্ত্রী। মায়ের বাবা আমার দাদু ছিলেন অন্ধ কিন্তু কি সুন্দর তরকারি কাটতেন, এটা ওটা ছোটখাট অসুখ করলে হোমিওপ্যাথিক ওষুধও দিতেন, যৌবনে ডিপ্লোমা ইঞ্জিয়ারিং পাশ করেছিলেন। মায়ের জন্মের পর অন্ধ। হাতের কারিগরিতে নিপুন ছিলেন, একটা যাঁতি বানিয়েছিলেন নিজের হাতে আমার অন্ধ দাদু- এ ভাবা যায় না। সেই লোকটাই সন্ধ্যেবেলায় নোয়াখালী ভাষায় শিবের গাজন গান গাইতেন।

আমার বাবা ছিলেন সবারই বড়ো জামাইবাবু। আর সব শালা শালি ছিল আমার বাবার কাছে নিজের ছেলে মেয়ে। আমার মামাবাড়ি এহেন এতো গোঁড়া ব্রাহ্মণ ও ধর্মপ্রাণ পরিবার হওয়া স্বত্ত্বেও আমার পিতৃদেব কী সুন্দরভাবে পাশ কাটাতেন আমার উপনয়ন করতে। না, আমার উপনয়ন হয়নি। এই রকম একটি বৈরী পরিবেশে কি করে পারলেন আমার বাবা আমার পৈতে না দিতে? তাঁর নাস্তিকতা ও ধার্মিকতার বিরুদ্ধে ঋজুভাবের কোনদিনও স্খলন ঘটেনি কিন্তু সবার প্রতি কী যত্ন, কী অপরিসীম স্নেহ! কেদার ঘাটে একবার বাবার সাথে বেড়াতে বেড়াতে চলে গেছিলাম। ভোর বেলা। একজন পুরুষ গঙ্গায় স্নান করে আচমন করছেন সূর্য প্রণাম করতে করতে, কী নিরীহ সেই মানুষটির ছবি! বাবা বললেন, দেখো কী পবিত্র মানুষটিকে লাগছে, এই ধর্মে তার বিশ্বাস আছে আর আছে সবাইকে গ্রহণ করার আকুতি। বললেন, চলো তোমাকে নিয়ে যাই বিশ্বনাথ মন্দিরে। সেখানে দেখলাম ভগবান বিশ্বনাথ বিগ্রহকে ছোঁয়ার জন্য ভক্তদের কী আস্ফালন! পুণ্যার্থীরা হুড়োহুড়ি করে কেউ পা মাড়িয়ে দিচ্ছে রাশ ছাড়া ভিড়ে, ঠেলে ফেলে দিচ্ছে, বাবা তো ধাক্কা খেয়ে পড়েই গেলেন। আমি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠি; বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম যাতে বাবা আর আঘাত না পান। আমি তখন শিশু। কী কান্না আমার! বাবা বেরিয়ে এসে আমাকে বললেন, বুঝলি বাবা, এটাই আমাদের দেশ। এভাবেই দেশটাকে চিনতে পারবি রে, কাঁদছিলিস কেন? আমি বললাম, তুমি পড়ে গেছো, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। বড়ো বয়সে বাবার সাথে একবার তুলসী মন্দিরে গেছিলাম। মন্দিরটি ঝাঁ চকচকে। সারা মন্দিরটির দেওয়ালে দেওয়ালে রামায়ণ লেখা আর তার ছবি আঁকা। একটা ছবিতে বিভীষণ রামকে প্রণাম করছে, সেই ছবিটা যেই দেখলেন বাবা বললেন, চিৎকার করে কয়েকটি লাইন-

কহো মহারথী, এ কি মহারথী প্রথা?

নাহি শিশু লঙ্কাপুরে শুনি না হাসিবে এ কথা…

স্বচ্ছ সরোবরে রাজহংস পঙ্কজ সলিলে

যায় কিসে কভূ প্রভু পঙ্কিল শৈবালদলের দাম…?

আশপাশের লোকজনেরা তেমন বুঝতে পারেন নি। পূজারী ছিলেন, তিনি হিন্দিভাষী মানুষ, তিনিও পারেন নি বুঝতে। বাবার বয়স তখন সত্তর, আমি তখন বছর চল্লিশ হবো। আমি জানি তখন বাবা ক্ষণেক্ষণেই কবিতা আওড়াতেন। এটা হয়েছে মাথায় এ্যাক্সিডেন্টের পরে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার পর। লাইনগুলো ছিল মেঘনাদবধ কাব্যের লাইন। তুলসী মন্দিরে থেকে বেরিয়ে এসে বাবাকে বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন তুমি ক্ষেপে গিয়ে হঠাৎ ইন্দ্রজিতের কথায় বিভীষণকে কটাক্ষ করে যে ডায়লগ সেটা আওড়াচ্ছিলে? তারা কেউ বোঝেনি, বুঝলে কী অপদস্থ হতে হতো বলোতো? বাবার সেই মিটিমিটি দুষ্টামির হাসি, বুঝলি, এটাকে বলে সাবভার্সন, ওদের ডেরাতে ঢুকে ওদেরকে আক্রমণ করে আসলাম। কিন্তু কেন? বাবা বললেন, পান খাওয়াবি না? বেনারসি পাতায় ফুর্তি দেওয়া ভিজে সুপুরি ও অদ্ভুত প্রবাদের খয়ের দিয়ে জর্দা পান। বাবা বললেন, তুই তো ভাল হিন্দি জানিস না, পরে যখনই বেনারসে আসবি, স্টেশনে নেমেই এরকম একটা পান খাবি, এই পান মুখে দিলেই হুড়হুড় করে হিন্দি বলতে পারবি। আমি ফিক্ করে হেসে ফেললাম।

তখন হিন্দিতে গুণগুণ করে বেনারসী কবীরের একটা কী যেন গান করছিলেন। এটা কি হিন্দীতে গাইছো ইন্টারন্যাশানাল? বাবা বললেন, চ’, যাই।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version