(গত সংখ্যার পর)

তখনও সূর্য ওঠেনি। ফুরফুরে হিমেল হাওয়ার সঙ্গে হালকা শীতের আমেজ রয়েছে। আর কয়েকদিন পর খেজুর রস ও গুড়ের মহল বসবে। গাছ কামিয়ে সুরু ও ছোট বাঁশের নল কিম্বা কাঠের তৈরি বিশেষ ধরনের গোঁজ ঢোকানো হবে। টাঙানো থাকবে মাটির কলসি।পুরুষানুক্রমে এই কাজ করে আসছে সাতশোগোড়া গ্ৰামের রসুন চাচার পরিবার। জমিদার বাড়ির সঙ্গে তাদের হৃদ্যতা রয়েছে বহু কাল আগে থেকেই। এই গ্ৰামের মানুষের ভালোবাসায় রওশন-এর বদলে বাচ্চা থেকে বুড়োদের কাছে সে শুধুই রসুন চাচা হয়ে গেছে। ছোটবেলায় বাপ কাকাদের সঙ্গে পা রেখেছিল পাশাপাশি গ্ৰামগুলোতে। কত লোকের বায়না মেটাতো তারা। অন্ধকার থাকতেই বোষ্টম পাড়ার নিরঞ্জন খুড়ো আর তার ভাই শ্যামচরণ বেরিয়ে পড়তো নাম বিলি ও প্রভাতী গাইতে। শ্রীখোল আর খঞ্জনির বোলে ঘুম ভাঙতো গাঁয়ের মানুষের। সেই সুর সেই আবেগ যেন বাঁধা আছে গাঁয়ের মানুষের মনে। কীর্তনাঙ্গের মধুমাখা গান, পদাবলী সুর আজও জীবন্ত করে রেখেছে গ্ৰাম জীবনের আবহ। সারা তল্লাটে তাদের গাওয়া প্রভাতী গানের মাধ্যমে জেগে উঠতো গ্ৰাম জনপদ। মনে শিহরণ জাগে নবীন থেকে প্রবীন মানুষের।

বাড়ির মেয়ে, বউ, ঝি সবাই তুলসীতলা থেকে দেবদেবীর মন্দির দেউলে জলভরা ঘটি আর এক হাতে গোবর নিয়ে মাড়ুলি দিয়ে ফিরত দল বেঁধে। তারপর কূয়ো থেকে কলতলা কিম্বা পুকুর ঘাটে ঘাটে বাসনমাজা, মুখধোয়ার পর্ব চলতো জম্পেশ। সঙ্গে শুরু হয়ে যেত খবর আদান প্রদানের হুল্লোড়। মাঝে মাঝে খুনসুটি, ঝগড়া, মুখ ঝামটার দৃশ্যগুলোও ছিল বেশ মুখরোচক। হাঁস, মুরগি ছাগল, গরু ছাড়ার পরপরই ফাঁকা হয়ে যেত ঘর গেরস্থালি, পুকুরের ঘাটগুলোও। চাষাভূষো মানুষ এখন মাঠমুখী। ক্ষেতের ফসল, শাক সবজি ভরা ঝাঁকা নিয়ে হাট বাজারমুখো একদল মানুষ। গাঁয়ে এখন শুধু সাইকেল নয়, ভ্যান রিকশারও চল হয়েছে। সুধন তাঁতির ছেলে জগন  আসানসোলের পাততাড়ি গুটিয়ে গাঁয়ে ফিরেছে। সঙ্গে দুটো অটো আর সেখানকার কলোনীর একটি মেয়েকে বৌ হিসেবে বিয়ে করে গাঁয়ে ফিরেছে। তার অটো দুটোই এখন গাঁয়ের ভরসা। এলাকায় তার বিরাট নামডাক আর কদর।

তার পোশাক-আশাক, চলন বলন সিনেমা আর্টিস্টদের মতো। চুলের ডিজাইনও নজরকাড়া। অনেকেই “মহাগুরু” বলে ডাকে। এলাকায় তার হাই ডিমান্ড শুধুমাত্র অটো দুটোর জন্য। বেশ কয়েকমাস পর তার শহুরে বৌ “কাকলি” নামে একটি ঝাঁ চকচকে বিউটি পার্লার খুলেছে। গাঁয়ের সঙ্গে শহর নগরের ছোঁয়া লেগেছে। বেড়েছে যাতায়াত। এখন সারা দিনরাত ধরে আর দুটো ট্রেনের যুগ নেই। প্রায় ছয়-আটখানা লোকাল ও প্যাসেঞ্জার ট্রেনের চলাচল শুরু হয়েছে। মানুষের ভরসাও বেড়ে গেছে বহুগুণ। কলকাতা, দুর্গাপুর, আসানসোল, ধানবাদ, রাঁচির সঙ্গে যোগসূত্র বেড়ে গেছে। হু হু করে বেড়ে চলেছে কর্মসংস্থান। ফাঁকা হয়ে পড়ছে গাঁ।

আজ সকাল সকাল কেতাদুরস্ত হয়ে ছড়ি হাতে মনিশেখর চাটুজ্যে বেরিয়েছেন প্রাতঃভ্রমনে। সঙ্গে আছে বাড়ির তিন’চারজন ছেলেমেয়ে। তাদের বায়না, জাল দিয়ে মাছ ধরা দেখবে। জেলে ডিঙি চড়ে একটুখানি ঘোরার ইচ্ছেও রয়েছে তাদের। সবার পিছনে আসছে মদন জেলের ছেলে পরাণ। কাঁধে মাছধরার জাল বাঁ হাতে খালুই। প্রথমে ভিন্ গাঁ থেকে বহু বছর আগে দু’য়েক ঘর জেলে পরিবারকে বাস করতে দিয়েছিলেন চাটুজ্যে’রা। গাঁ গঞ্জের মানুষ জেলেদের কেওট বলেও ডাকে। সম্ভবত জেলে কৈবর্ত থেকে এই কেওট কথাটি চালু হয়। সারা বছর এদের মাছ ধরে বেড়াতে হয়। নদীতে বর্ষা কালে ডিঙি, নৌকা ও ছোট পানসি’ চালিয়ে দু’চার টাকা আয় করে। বছরের বাকি সময়টা নদী, জোড়খাল, বিল ও দিঘি, পুকুরে মাছ ধরে সবাই। বর্তমানে জেলে পাড়ার মানুষদের দু’তিনটে ডোবা ও পুকুর হয়েছে নিজস্ব মালিকানায়। দীর্ঘ পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে জমিদার বাড়ির দশ’বারোটা বড়বড় দিঘি ও পুকুরে মাছ চাষ করে আসছে লিজ নিয়ে।

কাজলা দিঘির পাড়ে শানবাঁধানো চাতালে এসে বসলেন মনিশেখর। সঙ্গে আসা নাতি নাতনিদের দলকে বলে দিলেন, কেউই যেন পুকুর পাড়ের একদম ধারে না যায়। গভীর জল আর পদ্ম শালুকের লতাপাতা ভয়ঙ্করভাবে ছড়িয়ে আছে চারপাশ। যদিও গোটা পুকুর জুড়ে স্থায়ী বেড়া আর একটি ছোট্ট শেড রয়েছে পাহারাদার ও নৈশ প্রহরীর জন্য।

পরাণ ডিঙি ভাসিয়ে কাঁধে জাল নিয়ে নেমে পড়লো জলে।

চলবে…

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version