( দ্বিতীয় পর্ব)

পৌলমী ভৌমিক। ছবি: শুভব্রত গায়েন

দুদিনেই কেটে গেল প্রাথমিক আড়ষ্টতা

সকাল বেলা ইয়ালাং পার্ক থেকে বেরিয়েছি। গাড়িতে সবাই বলছে, আর একটা দিন থাকলে ভালো হতো। বুঝলাম, মেঘালয় ট্যুর এমন একটি টিম নিয়ে খুব আদর্শ হবে না বলে যারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, সেটা খুব প্রযোজ্য হচ্ছে না। অন্তত এখনো পর্যন্ত আমাদের ট্যুরটা বেশ উপভোগ করছি বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই।

আবার মসৃণ চওড়া উঁচুনিচু পথ। দুপাশে প্রকৃতির অসীম ভাণ্ডার। ঘন্টা আড়াই বাদে পৌঁছলাম একটা খোলা চত্বরে। এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে ক্র্যাং সুরি ফলস (Krang Suri falls)। আবার লাঠি হাতে হাঁটা শুরু । এবার সব থেকে বেশি উৎসাহ আমার পাঁচ বছরের ছেলে পোস্তর। পাহাড়ের গা বেয়ে সরু পথ। গাছে গাছে ছাওয়া, ভেজা ভেজা শেওলা পড়া সে পথ। অন্য দিকে গাছে ভরা খাদ। হঠাৎ বাঁক ঘুরতেই ভিউ পয়েন্ট। দূরে নিচে ক্র্যাং সুরি ফলস। চওড়া পাথরের ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া ঝর্ণা। সময়টা পুজোর পর, তাই জলও প্রবল। এই ঝর্ণার মজা হলো হেঁটে হেঁটে পৌঁছে যেতে পারা যায়, একেবারে ঝর্ণার তলায়। যেখানে মাথার ওপর থেকে সশব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জলরাশি। ঝর্ণার নিচটা ভেজা, যেন কুয়াশায় ঢাকা। এরকম অদ্ভুত ঝর্ণা যার নিচে পৌঁছনো যায়, সারা ভারতে আছে কিনা জানিনা! ফলসের থেকে উপরে উঠে, গাড়ির কাছ অবধি পথটা অনেকটা হলেও, একটু ধীরে ধীরে চললে বয়স্করাও অনায়াসে চলে যাবে। সারা পথে চোখে পড়ে ঝর্নার বিভিন্ন অংশের রূপ। পাহাড়ে নাম না জানা বুনো ফুলের বাহার, তাতে হাজারো রঙের প্রজাপতি। যেখানে পারো দাড়িয়ে দম নাও, আবার হাঁটো।

এবার যাবো ডাউকি নদীর অন্য পাড়ে স্মপডং গ্রামে

ক্র্যাং সুরি ফলস দেখে আবার গাড়িতে। যাবো ডাউকি নদীর তীরে স্মপডং (Shnongpdeng) গ্রামে। মেঘালয়ে যারা গিয়েছেন তাদের কাছে ডাউকি যথেষ্ট পরিচিত নাম। কিন্তু আমাদের মাথায় ঘুরছে অচেনা মেঘালয় ঘোরার ভুত! তাই আমরা চলেছি ডাউকি নদীর অন্য পাড়ের একটা ছোট্ট গ্রাম স্মপডং-এ। থাকব ওই গ্রামের এক হোম স্টে তে – Shatsangi Homestay।

গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ল পাহাড়ী গ্রামের রাস্তায়। পথে মাঝে মাঝে গ্রাম। এবার আমরা নামছি কারন নদীর কাছে পৌঁছে গিয়েছি। এক জায়গায় এসে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেল। রাস্তার থেকে নদীর পাড়ে নামতে বেশ কয়েকটা বড় পাথর – ওটাই সিঁড়ি। সঙ্গের বয়স্কদের মুখ আবার ফ্যাকাশে দেখালো। হঠাৎই দেখলাম হই হই করে নিচ থেকে উঠে এল তরতাজা তিন যুবক। যুবক না বলে অবশ্য তরুণ বলাটাই ভালো। হাত ধরে পরম যত্নে ওই পাথরের সিঁড়ি বেয়ে, অবলীলায় মা, বাবাদের নামিয়ে দিলো ওরা। বুঝলাম হোম স্টের মালিক বলে আমরা কলকাতা থেকে এতদিন কথা বলছিলাম যার সঙ্গে, সে এদেরই মধ্যে একজন। তবে সে যে একেবারে আঠারো বছরের বাচ্চা ছেলে হবে ভাবিনি।

উমগটের স্ফটিক স্বচ্ছ জলে চলছে মাছ ধরার পালা

চোখের সামনে উমগট (Umngot) নদী। সারা নদী ধরে মাছ ধরা নৌকায় বসে ছিপ ফেলে আছে বেশ কিছু মানুষ। যারা ডাউকির কথা জানেন, তারা এই উমগট নদীর কথা হয়তো শুনে থাকবেন। এত স্বচ্ছ এর জল যে নিচ অবধি দেখা যায়। নদীর এপার থেকে ওপার একটা সাসপেনশন ব্রিজ।নদীর ধারে ছোট্ট গ্রাম স্মপডং। গ্রামে ঢুকেই দু একটা বাড়ির পর একটা ছোট্ট দোতলা কাঠের বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। নিচে একটা বড় রুম। তারই বাইরে দিয়ে ছোট্ট বাঁশের সিঁড়ি উঠে গিয়েছে দোতলায়। ওপরে দারুন একটা খোলা বারান্দা, পাশেই একটা ঘর। জানলায় গ্রিল বা শিকের কোন বালাই নেই। দুটো খাট আর একটা টেবিল চেয়ার। খুবই সাধারণ কাঠের ঘরের আয়োজন। হু হু করে বইছে নদীর হাওয়া। সঙ্গে অবিরাম নদীর কুলকুল শব্দ।

বিছানার ওপর মুরগির ডিম

বড়রা নিচের ঘরে থাকাই মনস্থ করলেন। আমরা ওপরের ঘরে এলাম। পোস্ত লাফিয়ে খাটে উঠতে গিয়ে একটা চিৎকার করে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে দেখি, খাটের উপর একটা ডিম। হাতে নিয়ে তুলে দেখি, আসল! বুঝলাম এ ঘর সত্যিই প্রকৃতির ঘর। মানুষ থেকে মুরগি সবারই অবাধ বিচরণ। খুবই সাধারন সে ঘরে আড়ম্বরের বালাই নেই। তবু প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যাবার মতো বাড়ি। গরম গরম চা বিস্কুট খেয়ে কেউ কেউ স্নান সেরে নেবার প্ল্যান করলো। কেউ গ্রামটায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। ছোট্ট একটা গ্রাম। বাড়ির বাইরে বাচ্চারা খেলা করছে। উঠোনে মহিলারা রান্নায় ব্যস্ত। সবাই হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালো আমাদের। ভাষা! আমাদের বোধগম্য নয়। কিন্তু অভিব্যক্তি- তা শাশ্বত ও চিরন্তন। ভাষা সেখানে কোনো অন্তরায় নয়। পাশেই বাচ্চাদের স্কুলে প্রার্থনা সঙ্গীত চলছে। দূরে কোথাও বাজছে মন্দিরের ঘন্টা।

উমগট নদীর মাছ ভাজা আর ঝোল এলো নৌকায়

বেলা বেড়েছে। ক্ষিদেটাও বেশ জানান দিচ্ছে। স্নান সেরে কটেজের সামনে নদীর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ দেখি একটা নৌকা এপারের দিকেই এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরই বুঝলাম নৌকায় চড়ে আসছে সেই যুব বাহিনী। তীরে নৌকা লাগিয়ে ফটাফট তিনজন নৌকা থেকে নামিয়ে ফেললো থালা, বাটি, গ্লাস, চামচ, আর বড় বড় হটপট। বুঝলাম খাবার এলো ওপার থেকে। শুনলাম নদীর ওপারেই ওদের ক্যাম্পিং সাইট আর সেখানেই ওদের মাস্টার কিচেন। ওরা নিজেরাই রান্না করেছে। এরপর আর কথা বললে সময় নষ্ট হয়। ওপরের বারান্দায় নদীর হাওয়া আর কুলকুল শব্দের আবহে লাঞ্চ। দ্রুতগতিতে টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়ে ছেলে তিনটে দেখলাম বেপাত্তা। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত, স্যালাড, ডাল, আলুভাজা, উমগট নদীর মাছ ভাজা আর মাছের ঝোল। সে মাছের স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে। খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে এসে দেখি সিঁড়িতে লাইন দিয়ে দাড়িয়ে তিন মুর্তি। তাদের দেখে তো আমরা অবাক। সারা খাওয়ার সময়টা এরা দাঁড়িয়েছিলো এই ভেবে যদি আমাদের কিছু লাগে। সামনে আসেনি এই ভেবে যদি ভোজনে ব্যাঘাত ঘটে! অনেকেই বলেন, এই প্রজন্মের সংস্কার, শিষ্টাচার জলাঞ্জলি যেতে বসেছে। অথচ ভারতের উত্তর পূর্বের ছোট্ট এক রাজ্য মেঘালযের প্রায় অপরিচিত ছোট্ট ওই গ্রামের তিনজন তরুণ যুবকের আতিথেয়তা ও শিষ্টাচার আমরা গোটা পরিবার আজও ভুলতে পারিনি।

রাতের খাবার এলো লন্ঠন জ্বালানো নৌকায়

দুপুরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে, নদীর ধার বরাবর হেঁটে পৌঁছে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজটার কাছে। মনে ইচ্ছা ওপারে গিয়ে ওদের ক্যাম্পসাইটটা দেখে আসা। মা আর শাশুড়ি মা চার পা এগিয়েই ভযে চেঁচিয়ে উঠলেন, এ যে ভয়ানক দুলছে। তখন পোস্তর মজা দেখে কে! কোনও মতে মনে সাহস জুগিয়ে ওদের নিয়ে এগোলাম। ধীরে ধীরে মা রাও ছন্দ পেলো। সাসপেনশন ব্রিজের মাঝে দাড়িয়ে উপভোগ করলাম এক স্বর্গীয় দৃশ্য। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে উমগট নদী। কি যে তার সৌন্দর্য! চারিদিক সবুজে সবুজ। মেঘালয়ের আরেক নাম যে সবুজ, ততদিনে আমাদের চোখ তা স্বীকার করেই নিয়েছে। ক্যাম্প সাইটে বসে সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ আর চা শেষ করে আবার এপারে এলাম। নদীর ধারে জ্বলে উঠেছে আলো। ছেলে, বউ, বাচ্চা মিলিয়ে প্রাণবন্ত স্মপডং গ্রাম। চায়ের দোকানে গরম চা। ভেসে আসছে কোন মন্দিরের ঘণ্টা। ভাবলাম মন্দিরটা দেখলে হয়, সারাদিন পূজো হচ্ছে। নদীর ধারে গ্রামের রাস্তায় কেটে গেল সন্ধেবেলা। রাত আটটা নাগাদ আবার নৌকায় এলো আমাদের ডিনার, এবার নৌকায় লন্ঠন জ্বালিয়ে। রুটি, তরকারি, চিকেন, আর স্যালাড।

মাথার ওপর তারা ভরা আকাশ

খাওয়া দাওয়া শেষে বিছানায় ক্লান্ত শরীরটা ঠেকাতেই চোখ গেল ছাদে। আর অমনি চক্ষু চড়কগাছ। ছাদে শুধু তিনকোনা একটা শেড।চারিদিক ফাঁকা, সেখান দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্মপডং-র তারায় ভরা আকাশ। বিছানায় শুয়ে আক্ষরিক অর্থেই রাতের আকাশের তারা দেখা। রোমান্টিকতার চূড়ান্ত। তবে ঐ যে মা হবার ফল, সঙ্গে সঙ্গে মনে ভয় এলো, রাতে বৃষ্টি এলে তো বিছানায় শুয়ে শুয়েই স্নান করতে হবে। তবে ওই পরিষ্কার ঝকঝকে একফালি আকাশ দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। আশ্চর্যের বিষয়! ঘুম আসার আগে অবধি মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি শুনলাম।

ঘন্টাধ্বনি নয়, ‘ঘন্টাপোকা’

ভোর পাঁচটা থেকে মুরগির ডাক, নদীর শব্দ – সব মিলিয়ে ঘুম ভেঙে গেলো। নরম আলোয় সদ্য জাগা স্মপডং গ্রামে পায় হেঁটে ঘুরছি। এখানকার লোকেদের জীবনে যেন তাড়াহুড়ো শব্দটার কোন অস্থিত্ব নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার মুখে হাসি। নদীর ধারে চায়ের দোকানে সবে ডেকচিতে দুধ ফুটছে, সঙ্গে অনবরত ঘণ্টাধ্বনি। কৌতূহল চেপে রাখতে না-পেরে জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম। ভাষার একটা সাংঘাতিক ব্যাবধান থাকলেও, মনের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনদিনও তা মানুষের অন্তরায় হযে দাঁড়ায়নি। আরও আশ্চর্য হলাম একথা শুনে যে গ্রামে একটা চার্চ আছে বটে কিন্তু মন্দির তো নেই। কথাবার্তা আরও এগোলে বুঝলাম কাল থেকে যে লাগাতার ঘণ্টাধ্বনি শুনে যাচ্ছি, তা আসলে এখানকার ঝিঁঝিঁপোকার সমবেত কলতান ! পোস্ত অবিলম্বে নাম দিল – “ঘন্টাপোকা” ।

‘আবার আসিব ফিরে’

ব্রেকফাস্ট সেরে বিদায় নেবার পালা। গাড়ী চলে এসেছে ওপরের রাস্তায়। এদিকে পোস্তর নদীতে পাথর কুড়োনোর পালা শেষ হয়নি তখনও। মা,বাবারাও পাথরের ওপর বসে মাছ ধরা দেখছে। সবাইকে কোনও মতে তাড়া দিয়ে গাড়িতে তোলা হলো। আসার সময় কাঠের দোতলা বাড়িটার সামনে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাওয়া বাচ্চাটা আর আমাদের যুব বাহিনী – সবার কাছে নিঃশব্দ শপথ করে গেলাম – “আবার আসব”।
যেতে হবে অনেকটা পথ- চেরাপুঞ্জি।

(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version