হিন্দু দেবী মা কালীবেশী এক তরুণী সিগারেটে টান মেরে ধোঁয়া ছাড়ছে, একটি তথ্যচিত্রের পোস্টারের এই ছবি সামনে আসার পরেই উঠেছে বিতর্কের ঝড়। কালীর মুখে সিগারেট! তথ্যচিত্রের পরিচালক লীনা মণিমেকলাই পড়েছেন তীব্র জনরোষের মুখে। পরিচালক তাঁর টুইটারে তথ্যচিত্র 'কালী'র পোস্টার শেয়ার করার পর থেকেই পরিচালককে গ্রেপ্তারের দাবি উঠেছে, তাঁর বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, হিন্দু দেবীর অবমাননা করে শান্তি নষ্ট করার অভিপ্রায় সহ বেশ কয়েকটি ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। একই অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের পুলিশ এফআইআর দায়ের করেছে। ইতিমধ্যে তথ্যচিত্রটি কানাডা চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে। সেখানেও হিন্দুরা কালীর পোস্টার ঘিরে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

উল্লেখ্য, কিছুদিন আগেই পয়গম্বর বিতর্কে উত্তাল হয়েছিল দেশ।এরই মধ্যে দেবী কালীকে (Ma Kali Special Report) নিয়ে সাংসদ মহুয়া মৈত্রর একটি মিডিয়া গোষ্ঠীর কনক্লেভে করা মন্তব্য, ‘আমার কাছে মা কালী মাংস ও অ্যালকোহল গ্রহণকারী’। এতে বিতর্ক ছড়ায়। তাঁর দল থেকে ট্যুইট করে বলে দেওয়া হয় তারা মহুয়ার বক্তব্য মানছেন না। মহুয়া ট্যুইটে লেখেন, ‘সঙ্ঘীদের বলছি, মিথ্যা বলে খাঁটি হিন্দু হওয়া যায় না। আমি কোনও সিনেমা বা পোস্টারকে সমর্থন করিনি। ধূমপান শব্দটিরও উল্লেখ করিনি। আপনাদের বলছি, তারাপীঠে গিয়ে দেখে আসুন, মা কালীকে ভোগ হিসেবে কী খাবার ও পানীয় দেওয়া হয়’। মহুয়া মৈত্রর এই মন্তব্যকে যে বিজেপিহাতিয়ার করবে সেতো জানা কথাই। তারা মহুয়া মৈত্রর মা কালী সম্পর্কে এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর গ্রেফতারের দাবি তুলেছে।

কিন্তু যার তথ্যচিত্রের পোস্টার ঘিরে বিতর্কের ঝড় কে সেই লীনা মণিমেকালাই? মা কালী (Ma Kali Special Report) সিগারেট টানছে এই খবর আসার আগে তাঁকে কি এ দেশের কেউ চিনত? না চিনতেন না মহুয়া মৈত্র, চিনত না তাঁর দল, এমনকি বিজেপি। লীনা মণিমেকালাই কানাডার টরন্টোতে রয়েছেন কিন্তু তিনি তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ের মেয়ে। শিক্ষিত পরিবার হলেও অল্প বয়সে তাঁর বিয়ের পরিকল্পনা করায় লীনা বাড়ি ছেড়ে চেন্নাই চলে যান। সেখানে যোগ দেন একটি তামিল পত্রিকায়। ওই পত্রিকার মালিক লীনার ঘটনা জেনে তাঁকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেন। লীনা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শুরু করেন। কিন্তু পড়া শেষ হওয়ার আগে তাঁর বাবার মৃত্যুহলে পরিবারকে সাহায্য করতে আইটি ফার্মে যোগ দেন লীনা। কিন্তু স্বপ্ন দেখতেন সিনেমা তৈরির। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে মুক্তি পায় ‘মহাত্মা’। লীনার ছবি মানেই বিতর্ক। মহাত্মা সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা, অতএব শুরুতেই বিতর্ক। পরবর্তী ছবি একজন দলিত মহিলার জীবন নিয়ে। সে ছবিও বিতর্কিত। ধনুশকোডির জেলেদের দুর্দশার উপর তথ্যচিত্র ‘সেনগাদল’, সেই ছবি নিয়েও কেন্দ্রীয় সেন্সর বোর্ড আপত্তি তোলে। তাঁর প্রায় সব ছবি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত। অর্থাৎ ‘কালী’ প্রথম নয়।

সংবেদনশীল ‘হিন্দু’রা কালীবেশী এক তরুণীকে সিগারেট টানতে দেখে কিংবা মহুয়া মৈত্রের মন্তব্যেযে ক্ষেপে গিয়েছেন তারা মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল বা নিবেদিতার লেখা ‘কালী দ্য মাদার’-এর পাতা উলটে দেখতে পারেন। নিবেদিতার বক্তব্য অনুযায়ী,মা কালীর খোলা চুল আসলে বহমান কালের প্রতীক। তিনিস্বামীর বুকে পা দিয়ে আছেন, জিভও কেটেছেন কিন্তু তিনি ওম্যান অন টপ। বইটি শুধু আধ্যাত্মিক নয়, স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে নিবেদিতার এই বইটি বিপ্লবীদের কাছে বিশেষভাবে এক মন্ত্রপুস্তক হয়ে ওঠে। কালী মদ, মাংস খেতেই পারেন। সিগারেট বা গাঁজায় টান মারতেই পারেন। কিছুদিন আগে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ ছবিতে মন্দিরে রণবীরের জুতো পরে ঢোকার দৃশ্য দেখানোয় বিতর্ক উঠেছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় কটাক্ষের মুখে পড়েছিলেন ছবির পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায়। আসলে ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ টভিযোগগুলি বড্ড ক্লিশে।

‘ব্রহ্মযামল তন্ত্র’ অনুযায়ী বাংলায় যেকালীর বা কালী রূপটির পুজো হয় তা হল দক্ষিণাকালী বা শ্যামাকালী। ঋষি বশিষ্ঠ মদ-সহকারে যে তন্ত্রসিদ্ধ কালী পুজোর পদ্ধতি বঙ্গের বুকে প্রবর্তন করেছিলেন জনশ্রুতি বলে, তিনি হাজার বছর তপস্যা করেও সিদ্ধি অর্জন করতে পারছিলেন না। তখন তিনি বিষ্ণুর নির্দেশে চীনদেশে যান। সেখানে গিয়ে বশিষ্ঠ দেখেন, সেখানে পঞ্চ ম কার অর্থাৎ মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন সহকারে তন্ত্রমতে দেবী আরাধনা করা হয়। সেই সাধন পদ্ধতিই বশিষ্ঠ নিয়ে আসেন বঙ্গে। পণ্ডিতদের বক্তব্য, বৈষ্ণবদের পঞ্চগব্য অর্থাৎ দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-গোমূত্র-গোময়ের ঠিক বিপরীতেই অবস্থান করে শাক্তদের মদ্য-মাংস-মৎস্য-মুদ্রা-মৈথুন।

অন্যদিকে নিজের ছবি নিয়ে লীনা বলেন, তাঁর কালী তামিল এবং তেলেগু গ্রামের আচার-অনুষ্ঠান থেকে অনুপ্রাণিত, যেখানে সে মানুষের কাছে আত্মা হিসেবে আসে এবং মাংস খায়, সিগারেট, গাঁজার ধূমপান করে, দেশীয় অ্যারাক পান করে, গ্রামের মাঝখানে প্রস্রাব করে, থুতু ফেলে। যাকেতিনি বন্য নাচের উপর মূর্ত করেছেন ঔপনিবেশিকতা বোঝাতে এবংকালীকে হাঁটানোর জন্য অভিবাসীদের দেশ টরন্টো শহরের রাস্তা বেছে নিয়েছেন। সেই কালী টরন্টোর কেনসিংটন মার্কেটের চারপাশে একটি পার্কে একটি কালো রাস্তার বাসিন্দার কাছ থেকে সিগারেট নেন এবং টানতে থাকেন। হিন্দু ধর্ম বা বিশ্বাসের সঙ্গে এই কালীর কোনও সম্পর্ক নেই। এই কালীকে হিন্দু দেবী বলে দাবি করাটা কি একটি প্রহসন নয়। এই কালীর সঙ্গে ধর্মীয় ভাবাবেগেরই বা কি সম্পর্ক ? তাছাড়া কালী তো আদিবাসী লোককাহিনীতে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে। যে কারণে আঞ্চলিক এবং আদিবাসী সংস্কৃতিতে যতটা কালীর দেখা মেলে, ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু ধর্মে ততটা নয়। কালী কি কোনও দিনই ‘হিন্দু’ তথা ‘বৈদিক’ দেবী ছিলেন। তিনি তো অনার্য দেবী। যে অনার্য সভ্যতা কালী আর শিবকে শক্তি বলে মেনেছিল। যাদের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সংযোগ। আর সে কারণেই হিন্দুরা বহুকাল কালীকে ঘরে ঢোকায়নি। সেই উপাস্য কালীবেশী এক তরুণী যদি ফুকফুক করে সিগারেটে টান মারে তাতে হিন্দুত্ববাদীদের জাত যায় কিভাবে!

Share.

7 Comments

  1. অমরনাথ মন্ডল on

    সমন্ময় ও সার্ব্বজনীনতার কথা মাথায় রাখলে, এ ধরনের কাজ কেউ করেনা। আর যখন বিশ্বাস থাকে যে, নিজের মত অপব‍্যাখা করেও, হিন্দুদের কাছ থেকে, গর্জ্জন ছাড়া, TV র প্রাইম টাইমে ভীষণ বিতর্ক ছাড়া, কোন বিপদ নেই, তখন বিশ্বের যেকোন প্রান্তে, নিজের মত হিন্দুমত ব‍্যাখা করা যায়।
    কোন তন্ত্রব‍্যাখায় না গিয়ে জানাতে চাই – পুরোহিত দর্পণ খুললে দেখা যাবে, কালি পূজো সামগ্রী হিসাবে কারণবারি নেই। মদ দিয়ে পূজো সার্ব্বজনীন নয়।
    অনেক পরিবারে বাড়ির সব সদস‍্য একসাথে বসে হুইস্কি, সিগারেট সেবা করে থাকে। সেটা কখনও সার্ব্বজনীন নয়। এই ব্রাকেটে সমস্ত ভারতীয় পরিবারকে দেখালে, বেশীরভাগ পরিবার অপমানিত বোধ করবেন বলেই বিশ্বাস।

  2. kanti ranjan dey on

    গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণ।
    সমৃদ্ধ লেখা।

  3. shamol dutta on

    খুব ভালো লাগলো।।ধর্মান্ধতা যুক্তি তর্কের ধার ধারেনা । সর্বপরি রাজনীতির ব্যাপারিরা আছেন।

  4. Rina Mitra Ghosh on

    অনেক কিছুই জানা তথ্য, কারণ আমার মামাবাড়ি কালী পুজো হয়, পড়তে খুব ভাল লাগল।

Leave A Reply

Exit mobile version