বেশ বড়সড় একটা পাথর সেটাই নাকি সীমানা ভুটান ভারতের পাহাড়ি রাস্তা শেষ হলে খাদ্ নিচে বহতা ডায়না আর তার গা ছুঁয়ে ভুটান পাহাড়। কাঁটাতার বা প্রাচীর দিয়ে এই ভৌগোলিক সীমারেখ ফ্রেম করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই।  এখানকার প্রাকৃতিক ক্যারিশমা এমনই। দুই দেশের সরকার আর কি করে? অগত্যা এই পাথর। ঘাস খেয়ে জাবর কাটতে কাটতে অচিরেই ও দেশ থেকে গরু এ দেশে ফেরে। এ দেশের সব পাখি ঘরে ফেরে সেও ও দেশ থেকেই। অদ্ভুত এই সীমারেখার জায়গাটির নামটিও ভারী অদ্ভুত, লাল ঝামেলা।  

চালশা থেকে 22 কিলোমিটার দূরে ভারত ভুটানের কোলে প্রায় অনাবিষ্কৃত স্থানটির ঘোর কাটতে সময় লাগে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ডুয়ার্সের লোকসান চা বাগানের নিকট এই জায়গাটি সংরক্ষিত ছিল। ভারত সরকারের সেই প্রজেক্ট কার্যকরী না হওয়ায় লোকসান চা বাগানের মালিক জায়গাটিকে নিজের মালিকানায় আনার চেষ্টা করেন। তখন থেকেই ঝামেলার সূত্রপাত। 

তখন আমার ক্লাস ফাইভ, বাবার সঙ্গে গিয়েছিলাম মনে আছে বাবার প্রাক্তন সহকর্মী লোকসান চা বাগানের ম্যানেজার এর বাড়িতে। কৌতূহলবশত আমি প্রশ্ন করেছিলাম ব্যবসায় লাভবান হবার জন্যই তো লোককে ব্যবসা করেন। তাহলে এই চা বাগানের নাম লোকসান কেন? বাবার সেই সহকর্মী বন্ধুটি বলেছিলেন মিস্টার রবিনসনের অন্যান্য চা বাগান গুলির মধ্যে লোকসান অন্যতম ছিল। তখনো এই চা বাগানের নামকরণ হয়নি। ওয়ান ফাইন মর্নিং বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখে বিস্মিত হয়ে সাহেব মেম সাহেব কে ডেকে বললেন লুক দ্যা সান। বারান্দায় বেতের টেবিলে চা পরিবেশন করতে করতে বাবুর্চি ভাবলেন চা-বাগানের আজ নতুন নামকরণ হলো লোকসান। 

এই চা বাগানের মালিক যখন জায়গাটিকে দখল করতে চান স্থানীয় অধিবাসীরা প্রবল বাধা দেয়। অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন দুই ব্যক্তি। কাকতালীয় ভাবে তাদের দুজনেরই নাম সোমরা ওঁরাও। এদের একজন তীরন্দাজ। তীর বা বল্লম দিয়ে লাল রক্ত ঝরিয়ে প্রতিবাদ করতেন বলে তার নাম হয় লাল সোমরা ওঁরাও। অন্যজন যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন না বটে কিন্তু বেজায় ঝামেলা পাকিয়ে জমি আঁকড়ে রাখতেন। অতএব তিনি ঝামেলা সোমরা ওঁরাও। অবশেষে লোকসান চা-বাগানের দলবল স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে হার মেনে রণে ভঙ্গ দেয়। লাভবান হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। যাদের প্রচেষ্টা  ছাড়া এই যুদ্ধ জেতা অসম্ভব ছিল তাদের সম্মান জানাতে জায়গার নাম হয় লাল ঝামেলা। 

লাল ঝামেলায় যেতে গেলে বেসক্যাম্প করুন চালশা কে। দ্রষ্টব্য শুধুই প্রকৃতি। ঘন সবুজ ঘাসের মাঝারি উপত্যকা, নিচে বয়ে চলা ডায়না নদী। হাত বাড়ালেই মনে হয় ধরতে পেরে যাব এতই কাছে ভুটান পাহাড়।

দুই দেশের মাঝখানে ঝুলন্ত সেতু। পাহাড়ের কোলে যেটাকে হ্যামক বলে মনে হয়। পৃথিবীময় নীল সবুজের ক্যানভাসে ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়ালে জগত ভুলে থাকা যায়। মাঝে মাঝে প্রবল হওয়ার গতি। মনে হয় ইংরেজি ছবিতে দেখা কোন দৃশ্যের মতোই এই বুঝি ব্রিজ ছিঁড়ে পড়ে গেল।। সেই দোলায় মাথা ঘোরে। এই ব্রিজটি ভার্টিগো রোগীদের জন্য একদম নিরাপদ নয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাউকে নিয়ে গেলে অচিরেই ওপারে যাবার অনুমতি মেলে। তাদের কথায়  “বন্ধু দেশ তো, ব্রীজের ডিউটি করা কালীন জল বা সিগারেট শেষ হয়ে গেলে আমরাইতো দিয়ে দিই”। কতক্ষণ আর ওই নির্জনে বসে একা ডিউটি করা যায়? এক ভুটানিজ গার্ডের সঙ্গে ছবি তুলে দিয়েছিলো আমার কন্যা। ভদ্রলোকের কাছে কিছুই ছিলনা আপ্যায়ন করার মত। আমাকে প্রথমে গুটকা অফার করলেন আমি খাই না বলায় একটা সিগারেট এগিয়ে দিয়ে মাতৃভাষায় যা বললেন তার অর্থ এই -আমাদের দেশে এলেন এই প্রত্যন্ত এলাকায় এ ছাড়া আর কি দিয়ে আতিথেয়তা করব? ওর এই আন্তরিকতা আর সারল্যের মর্যাদা দিত অগত্যা…

ঝুলন্ত সেতুর মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন যতক্ষন ইচ্ছে। অনেক নিচে বয়ে চলা ডায়না নদীর গর্জনের অনুরণন শুনতে পাবেন কলকাতায় ফিরে এসেও। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এবারে ডায়নার রিভার বেডে যাওয়া যাক। বেশ চড়াই উৎরাই ভাঙতে হবে। আমি গিয়েছিলাম মার্চ মাসে। তখন জলোচ্ছ্বাস কম। তটিনী কেমন হিল্লোল করে কল্লোল তুলে যায় এটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারবেন। বড় পাথরে বসে থাকা যায় পা ডুবিয়ে নদীর জলে। ঠান্ডা জলের প্রাথমিক ধাক্কা একসময় গা সয়ে যায়। পাহাড়ি নদীর জলে পা ডুবিয়ে চারপাশে ঘন সবুজ পাহাড়,নীল আকাশ আর ঝুলন্ত সেতুর প্রেক্ষাপটে দাঁড়ালে জাগতিক ক্ষুদ্র বৃহৎ জ্বালা-যন্ত্রণা কে তুচ্ছ মনে হয়। 

ওখানে বসেই দেখতে পাবেন স্থানীয় কিছু ছেলেপুলে মাছ ধরছে। ডুয়ার্সের প্রায় সব জায়গাতেই মাছ ধরার এই এক নতুন পদ্ধতি শুরু হয়েছিল। ব্যাটারি চালিত বিদ্যুৎ প্রয়োগ করে এরা মাছ ধরে। যেটুকু জায়গা পর্যন্ত বিদ্যুৎ প্রবাহ বিস্তৃত হয় সে জায়গার মাছ তো মরেই উপরন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখে এমন জলজ প্রাণীর মৃত্যু হয়।ভাগ্যক্রমে যারা বেঁচে যায় তারা প্রযোজন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে । আশার কথা এই এখন সরকারের পক্ষ থেকে নানারকম কর্মসূচির দাঁড়া এই পদ্ধতি বেশ কিছুটা কমানো গিয়েছে।বন বিভাগের কর্মীরা এগিয়ে এসেছেন এই প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য। 

যদি ইচ্ছে হয়, ভালো লাগে নদীর জলে বসেই সঙ্গে আনা লাঞ্চ প্যাকেট খুলে প্রকৃতির কোলে বসে লাঞ্চ করে নিতে পারেন।  গুপী-বাঘার মত নদীর জলে ধুয়ে নেয়া যায় হাত মুখ। এবারে নদী থেকে ওপরে এসে ঘাসে শতরঞ্জি বিছিয়ে  চলুক আড্ডা। 

চারপাশের আলো কমে আসে ধীরে ধীরে। সন্ধ্যে নামে বকের পাখায়। হাজার পাখি ঘরে ফেরে। খাদের সামনে আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম আমার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বকের দল। মাঝে মাঝেই আমাকে মাথা নিচু করতে হচ্ছিল। যে গতিতে ওরা আসছিলো আমার মাথা মুন্ডু এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতেই পারে অনায়াসে। ওদের পাখার ছটফটানি আমার কানে ,ডানার হাওয়া আমার গায়ে, ঘোর লাগা অবস্থায় কতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা। ঘোর কাটল আমার কন্যা হঠাৎ দৌঁড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে। আলো-আঁধারিতে হাজারো ঝিঝির কনসার্টে আমার ফুলনদেবী ভয় পেয়েছেন।  

মধ্যাহ্নভোজন এর শেষে সবাই যখন আড্ডায় আমি স্থানীয় এক ব্যক্তির সঙ্গে বেশ খানিকটা ঢালুপথ পেয়ে গেলাম এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা করতে। অশীতিপর বৃদ্ধ বেশ অসুস্থ ছিলেন। অসম্ভব ব্যক্তিত্ব। অনেক পুরনো দিনের গল্প করলেন। নুন দেওয়া লিকার চা খাওয়ালেন। আমি কিছুটা ইতস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেললাম । আপনি কোন সোমরা ওঁরাও? নড়বড়ে পায়ে  ঘরে গেলেন বৃদ্ধ। কাঁপা হাতে আমাকে দেখতে দিলেন একটি ভোটার পরিচয় পত্র। আকস্মিক এই পরিচয় পত্র কেন আমাকে দেখতে দিলেন? এ আবার কেমন বৃদ্ধের ছেলেমানুষি ?পরিচয় পত্র টি ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম নাম ঝামেলা  সোমরা ওঁরাও। বিস্মিত আমি ওর দিকে তাকাতেই হাসলেন । সেই হাসি ফ্রেম করার মতো কোন বিখ্যাত কোম্পানির ক্যামেরা আমার কাছে ছিল না। 

কিভাবে যাবেন এবং কোথায় থাকবেনঃ  শিয়ালদা থেকে এনজিপি এখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে যান চালশা বেশ কয়েক বছর হল পশ্চিমবঙ্গ সরকার পথের সাথী প্রকল্পের বেশ কয়েকটা ইয়ুথ হোস্টেল করেছে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় শুধু পর্যটকদের নয় আম জনতার এখন এ খবর জানা সেই সরকারি বিরাট মাপের ইয়ুথ হোস্টেল আছে চালশাতেও। আদিগন্ত বিস্তৃত জায়গাটিতে জঙ্গলের মাঝে সেখানে থাকাটাও একটা অভিজ্ঞতাই বটে। সুলভ মূল্যে থাকা এবং খাওয়ার এ।মন ব্যবস্থা ডুয়ার্সের খুব কম জায়গাতেই আছে। লাল ঝামেলায় যেতে গেলে এখান থেকেই ব্রেকফাস্ট লাঞ্চ পার্সেল করে নিয়ে যেতে পারেন চালশা থেকে এর দূরত্ব 22 কিলোমিটার চালশা থেকেই লাল ঝামেলায় যাওয়ার ও আসার গাড়ি ভাড়া পেয়ে যাবেন এছাড়াও লাল ঝামেলা তেও দু-একটি হোম স্টে রয়েছে।  Non AC Double bedroom₹650(accomodation,6.) , AC Double bedroom  (₹900), single bed room(₹315) accomodation 11,Non ac triple bedroom (₹757) accomodation 8, dormitory (₹200) accomodation 12,VIP room (₹1150)).
Share.

1 Comment

  1. mandira banerjee on

    যেমন অদ্ভুত জায়গার নাম তেমনি অপূর্ব তার চারপাশ, লেখিকার লেখনি আরও চমৎকার করে দিল।

Leave A Reply

Exit mobile version