ঝরা পাতার কাঁপন ফিকে হয়ে এলে, হাড় হিম করা উত্তুরে বাতাসে হাঁফ ধরে আসে। ধোঁয়া ধোঁয়া চরাচরে চলকে ওঠে বাসন্তী রোদ্দুর। হলুদ শস্যের ভারে ভরে যায় পৃথিবীর বুক। নিস্তরঙ্গ ঝরা পাতার হাহুতাশে লেগে থাকে ছলছল শিশিরের আলিঙ্গন। সজনে ফুলের ঝিরিঝিরি হাসিতে উছলে ওঠে হৃদয়ের অবারিত প্রাঙ্গন।

থইথই জ্যোৎস্নায় মায়া টান লাগে। টোল পড়া গাল বেয়ে গলে পড়ে অন্তহীন উচ্ছ্বাস। ভেজা ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলা আঙুল, ছুঁয়ে ফেলে মন কেমনের শ্বাসপ্রশ্বাস। উতলা চরাচরে ঝুপ করে নেমে আসে আজন্মের ভালোবাসার ব্যাকুলিত নীলাকাশ।

বসন্ত এলে, ঝাঁক ঝাঁক ভালোবাসা এসে মহুল বনের বারান্দায় পাটি পেতে বসে। সঙ্গে আনে থোকা থোকা কবেকার সেই ধুলোবালি! বসন্তের উদাসী গন্ধ গায়ে মেখে সাড় দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নিঃসীম অরণ্য, নীলাভ পাহাড় আর নিস্তরঙ্গ নদী। পাহাড়ের ঢালে আটকে থাকা হাহুতাশগুলো ঢাকা পড়ে যায় রক্তপলাশের আকাঙ্ক্ষার অবগুণ্ঠনে। লাল মাটির নেশাতুর গন্ধে ভুরভুর করে ওঠে স্যাঁতস্যাঁতে হৃদয়ের বসন্ত-যাপন।

হৃদয়ের বসন্ত তো কখনও একা আসে না। সঙ্গে নিয়ে আসে কত কি! উতলা বাতাসের অস্থির আকুলতা। আহ্লাদী রোদ্দুরের উদ্বেল বিহ্বলতা। মন কেমনের উচাটন ব্যাকুলতা। অগোছালো বাসন্তী শাড়ির মর্মভেদী ইশারা। এলোচুলের তরঙ্গে প্রেম নিবেদনের অবাধ আস্কারা। উৎকণ্ঠিত অপেক্ষার প্রহর। স্বপ্ন বোঝাই নিদ্রাহীন রাতভর। দখিণা হাওয়ার হৃদয়ে কলকল নদীর বিরামহীন বিচরণ। শিমূলের রাঙা চোখে মন হারানোর নিমন্ত্রন। পলাশের তৃষ্ণার্ত ঠোঁটে বসন্তের চুম্বন।

আবছায়া গায়ে মেখে কাকভোরে জেগে ওঠে বসন্ত পঞ্চমী। পাতা ঝরা শোকার্ত গাছেদের ক্ষতে ঝিরিঝিরি বাতাসের প্রলেপ লাগে। শিশির ভেজা সকালের হিমেল বাহুতে ডানা মেলে স্পর্ধার রোদ্দুর। মহল্লায় মহল্লায় মুঠোভরা ভালোলাগার উন্মাদনায় বল্গাহীন কৈশোর। অঞ্জলির ফুল-বেলপাতা-মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে যায় আড়চোখের বানভাসি উচ্ছ্বাসে। উদ্দাম কালবৈশাখী যেন ঝুপ করে নেমে আসে ভালোবাসা মাখা উত্তাল রক্তস্রোতে। বিনিদ্র পাখির নীড়ে পড়ে থাকা পরিতৃপ্তির ওম গায়ে মেখে, দুটি কাঁচা প্রাণ একাকার হয়ে যায় মন কেমনের নিঃসীম প্রান্তরে।

সে এক যুগ! সে এক দুর্দমনীয় কৈশোরবেলা। এক আশ্চর্য উন্মনা দিগর। এক ঝাঁক তরতাজা প্রাণের দুর্বার আকুতি। লালপেড়ে হলদে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে মেঘেদের বসতি। নাহ্‌, “বসন্ত এসে গেছে” বলে কোনও গান লেখা হয়নি তখনও। তথাপি নিযুত কোটি থরথর হিয়ার অন্তর জুড়ে ধিকিধিকি বসন্ত। লাজুক আড়চোখের ইশারায় অকপট ভালোবাসার আমন্ত্রণ। সেযুগে প্রকাশ্যে প্রেমালাপের সুযোগ ছিল বড়ই সংকীর্ণ। অথচ অনর্গল কথারা নীরবে বয়ে যেতো ফল্গু নদীর অলীক ভাষায়।

কালের যাত্রায় চাপা পড়ে থাকা লয়হীন সেইসব কথারা মিটিমিটি চোখ মেলে বসন্তের আদুরী পরশে। থোকা থোকা ভালোলাগা এসে উদ্বেলিত চরাচরের শরীর জাপটে ধরে। মেঠো ফুল খিলখিল করে হেসে ওঠে। সদ্য মাথা তোলা পাতার মতো, অবুঝ ভালোবাসা তিরতির করে কাঁপতে থাকে। সকল পাওয়ার সুখানুভূতি ডানা মেলে মিলিয়ে যায় দিগন্তের ঠিকানায়। দুর্মর ভালোবাসা আনমনে হেঁটে চলে, কবেকার ফেলা আসা অবিকল সেই মেঠো পথ ধরে।

তার পর! হেঁটেই চলেছি ধুলো ওড়ানো অন্তহীন পথ। পথে দেখা হয়েছে ঝাঁক ঝাঁক  রোদ্দুরের। ঝরঝর বৃষ্টিধারায় জীবন ভিজেছে অনর্গল। বারেবারে ধুয়ে গেছে চোখের পলকে জড়িয়ে থাকা পথের ধুলো। তারপর একদিন মেঘ সরে গেছে। বানভাসি জ্যোৎস্না এসে স্নিগ্ধ করেছে উৎকণ্ঠিত আলোআঁধারি পথ। পায়ে পায়ে জড়িয়ে গেছে বন-বনান্তর। পায়ে পায়ে নেমে এসেছে আকাশও। তবু লাজুক ভালোবাসা নিযুত বর্ষ ধরে লুকিয়ে থেকেছে আবছায়া ঘেরা নিখাদ হৃৎস্পন্দনেই।

বসন্ত এলে, কুয়াশার ফাঁক গলে ছিটকে আসা ঝলমলে রোদ্দুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পরিত্যক্ত প্রণয়। দেওয়ালে আটকে থাকা শামুকের মতো গভীর চুম্বনের দাগ, বসন্তের কপালে আজও লেগে আছে নিশ্চয়। বসন্ত পঞ্চমীর আশ্চর্য মায়াবী সকালে যার কাঁপা কাঁপা ঠোঁট ছুঁয়ে ফেলেছিলাম আঙুলে কুয়াশা মেখে, আজ, এত কাল পরেও, সে আমার কাছে চতুর্দশীই থেকে গেছে!

লেখক অধ্যাপক, সমাজ-রাজনিতি-পরিবেশ বিশ্লেষক

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version