(দ্বিতীয় পর্ব)

ইন্দ্রনীল বসু

পরদিন সকাল হতেই দেখি আমাদের হোটেলের লাগোয়া একটা আপেল বাগান। ছোটো ছোটো দুটো ছেলে একটা লাঠি দিয়ে আপেল পারছে। বাগানের মালিক দাঁড়িয়ে আছে সামনে। আর দুটো ছেলেকে দিয়ে বস্তায় আপেল ভরাচ্ছে। আমাদের হোটেলের একটি ছেলে আমার আপেল দিকে জুল জুল দৃষ্টি দেখে বললো, “আপ ছিটকুল ঘুম আইয়ে । ইয়ে হোটেল কা আপনা বাগান হ্যায় । আপ কো লে জাযেগা।” শুনলাম এখানে এক হাত অন্তর অন্তর আপেল বাগান আছে। কিন্তু ট্যুরিস্টদের অত্যাচারে সব বাগানের মালিক বড় বড় পাহাড়ি কুকুর পুষে রেখেছে। মালিকের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করলেই তারা পরিত্রাহী চিৎকার করে তাড়া করে কলকাতার বাবুদের। কি সব্বনাশ। সকাল সাড়ে নটায় অশোকজীগাড়ি নিয়ে হাজির। স্নান আর ব্রেকফাস্ট করে তৈরি ছিলাম। গাড়ি আসতেই বেরিয়ে পরলাম।

সাংলা থেকে ছিটকুল যাওয়ার রাস্তাটা অতি মনোরম। প্রথমে একটার পর একটা আপেল বাগান। তারপর পাইন আর দেওদারের মধ্যে দিয়ে আঁকা বাঁকা রাস্তা। শুধু সবুজ আর সবুজ। শীতের শুরুতে ঝরে পড়ার অপেক্ষায় থাকা গাছের পাতার দল জঙ্গলে যেন রঙের আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট পাহাড়ি গ্রাম চোখে পড়ছে। তার মধ্যে দিয়ে এর বাড়ি ওর বাড়ি, এর জমি ওর ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছি। আবার কোথাও কোথাও জঙ্গল এত ঘন যে সূর্যের আলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় পাইন আর ওক সূর্যের আলোর পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও আবার জঙ্গল উধাও হয়ে গিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত খাদ আর পর্বতশ্রেণী তার রূপ উজাড় করে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ছে। সাংলা ছাড়তেই বসপা নদী সঙ্গী হয়েছিল আমাদের। বসপাকে সঙ্গী করেই এগিয়ে চললাম। গাড়ির গতি এই পথে অত্যন্ত শ্লথ। ছিটকুলের পথে মাস্ত্রাং গ্রাম ছাড়িয়ে ছিটকুল উপত্যকা। অবশেষে সংলা থেকে ছিটকুল এসে উপস্থিত হলাম। দুরত্ব মাত্র ২৬ কিলোমিটার। কিন্তু আসতে প্রায় দেড় দুঘন্টা লেগে যায়। হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। তিব্বত সীমান্তের শেষ গ্রাম বলে কথা।

ওপর থেকে নিচে নেমে গেলাম বসপা নদীর সঙ্গে আলাপ জমাতে। রোদের তেজ ছিল খুব। তাই ঠান্ডাটা আর অত গায়ে লাগছে না। এরই মধ্যে দেখলাম পাহাড়ি মেষপালক একদল ভেড়া আর ইয়াক নিয়ে কোনো প্রান্তরের দিকে হেঁটে চলেছে। সঙ্গে পাহাড়ি কুকুর। হাজির হলাম বসপা নদীর ধারে। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে খরস্রোতা বসপা। নদী আপন বেগে পাগল পারা। ট্যুরিস্ট পার্টি পাথরের ওপর বসে খচাখচ ছবি তুলছে। দূরে দূরে তুষারাবৃত পর্বত শৃঙ্গ। নীল আকাশে ভেসে চলেছে আশ্বিনের সাদা মেঘ। একটা পাথরের ওপর গিয়ে বসলাম আমরা। কতক্ষন জানি না। উঠতে আর ইচ্ছা করছিল না। এমন অপার শান্তি , এমন প্রকৃতির রূপ ছেড়ে কি আর আসতে ইচ্ছা করে ? সম্বিত ফিরে পেলাম ড্রাইভার সাহেবের ফোনে। একটা ধাবাতে ফেরার পথে খেয়ে নিলাম। রুটি আর তরকা। সঙ্গে এককাপ স্ট্রং কফি। ফেরার পথে ঘন কালো মেঘ আস্তে আস্তে পর্বতচূড়াকে ঢেকে দিল। ফিরে এসে আপেল বাগান দেখলাম। দু’পেটি গ্রীন অ্যাপেল কিনলাম।

সন্ধেবেলা পূর্ণিমার আলোয় দিকবিদিক ভেসে যাচ্ছিল। ঝিঝির ডাক কানে আসছে। নিস্তব্ধ চারিদিক। থেকে থেকে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত মনে আসছে – নিশীথ রাতে নিবিড় সুরে/ বাঁশিতে তান দাও হে পুরে।

পরদিন চলে এলাম কল্পা। কল্পা ঢোকার আগেই ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো শিবলিঙ্গ পর্বত দেখার জন্য। শিবের আকৃতির একটা পর্বত চুড়া। ওখানকার মানুষের খুব ভক্তি দেখলাম। অনেকেই ওই চূড়াকে হাতজোড় করে নমস্কার করছে। কল্পায় গাড়ি পৌঁছলো যখন তখন সকাল এগারোটা। এখনও বেশ ঠাণ্ডা। কল্পা ঢোকার আগে একটা আপেল বাগান দেখলাম। কল্পায় তিব্বতীয় প্যাগোডা স্ট্যাইলে তৈরি নারায়ন নাগিনী মন্দির আছে। আর জায়গাটা যেন পটে আঁকা ছবি। দোকানপাট , স্থানীয় মানুষজন বেশ দেখা যায় এখানে। অশোকজী জানালেন দশেরায় কিন্নরের ফুলের উৎসব ফুলাইচ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। নারায়ন নাগিনী মন্দিরে ফুলাইচের সূচনা হয় নাচের তালে তালে। ঢোলক বাজে, সবাই নাচে। পরিবারের অন্তত একজন যান দূর পাহাড়ে ফুল সংগ্রহ করতে। উৎসবের মাধ্যমে গ্রামবাসীরা ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানান একটি সফল আপেল মরশুমের জন্য।

সেদিনটা কল্পায় থেকে তারপরদিন রওনা দিলাম সিমলার পথে।

                                                                          (শেষ)
Share.
Leave A Reply

Exit mobile version