অপূর্ব মিত্র

দ্বিতীয় পর্ব
পথের কথা —-
সকাল ছ’টার অনেক আগেই বাসে এসে জায়গা ধরেছি। ড্রাইভার মাঝে মাঝেই হর্ন দিয়ে অ্যালার্ম দিচ্ছে। ফর্সা চেহারায় দুধ সাদা প্যান্ট আর লাল রঙের টী-শার্ট পরিহিত আমাদের ড্রাইভার সাহেবকে বেশ রাজপুত্রের মত লাগছে। আমরা তো ওনার নাম ‘লাল্টু’ ঠিক করেই ফেললাম। ঘন কালো চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো আর মুখে সবসময় হাসি লেগেই রয়েছে। রাস্তার সব মানুষই যেন ওনার পরচিত এবং উনিও তাঁদের কাছে বেশ সম্মানিত ব্যক্তি। রাস্তায় প্রত্যকের ডাকে হাসিমুখে স্টীয়ারিং থেকে হাত তুলে সাড়া দিচ্ছিলেন। আর পাহাড়ের ডাক ব্যবস্থা অর্থাৎ চিঠিপত্রের থলে এক পোস্ট অফিস থেকে আরেক পোস্ট অফিসে রাস্তার উপর নামাতে নামাতে চলছিলেন। সেই সুবাদে যখনই গাড়ী থামাতে হচ্ছিল তখনই তিনি প্যান্টের পিছন পকেট থেকে চিরুণী বার করে চুল আঁচড়ে নিচ্ছিলেন। এই ডাকহরকরার কাজের বিনিময়ে পাচ্ছিলেন চুন খয়ের দেওয়া একটা জর্দা পান। ড্রাইভারের বদলে তাঁকে বাসের পাইলট বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ কোন বাস ড্রাইভারকে এমন সম্মান করতে ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। যাই হোক, প্রতিবার হাত তুলে অভিবাদনের প্রত্যুত্তর জানাতে গিয়ে কয়েকবার পাহাড়ের দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচেও প্রায় এগারোটা নাগাদ বাস আমাদের নিয়ে গেজিং পৌঁছাল। গেজিং বাসস্ট্যান্ডটাই ছিল ওখানকার ম্যাল। গেজিংয়ের উচ্চতা প্রায় ৬৫০০ ফিট বা কিছু বেশি। আর উচ্চতার জন্য বেশ কনকনে ঠান্ডা। কিছু খাবারের দোকান, কাপড়ের দোকান, আর অন্য কিছু দোকান এবং বার বা বসে মদ্যপানের ব্যবস্থা। ওটাই ওখানকার স্থানীয় বাজার। যাই হোক, ঘন্টা খানেক বিশ্রাম নিয়ে ও হালকা টিফিনের পর বাস রওনা দিল ইয়কসামের উদ্দেশ্যে। অতি অবশ্য আমরাও বাসের মধ্যে ছিলাম। ‘লাল্টু’ বাস স্টার্ট দিতেই আমাদের তাপস আবিষ্কার করল যে পিছনের সীটে যেখানে থাকার কথা সেখানে তার ব্যাগ নেই। হঠাৎ মনে পড়ল গেজিং-এ যেখানে বসে খাচ্ছিল, সেই দোকানেই ওর ক্যামেরার ব্যাগ ফেলে এসছে। অতএব আবার নেমে ব্যাগ উদ্ধার। দোকানদার আস্বস্ত করেছিল যে ফেলে রাখলেও পাহাড়ে কোন জিনিষ হারানোর নয়। ফের জমিয়ে বসে পাহাড়ী নিসর্গ উপভোগ করতে করতে যখন গন্তব্যে পৌঁছালাম, বেলা তখন প্রায় সাড়ে তিনটে। ৬০০০ হাজার ফিটের ইয়কসামে নামলাম। ছবির মতে সুন্দর, বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এলাকাটা নেপালি বসতির আধিক্য। ইন্দিরা নামের একটা ছবির মত হোটেলে গিয়ে উঠলাম। হোটেলের ভিতরের দেওয়ালে সুন্দরী পাহাড়ি যুবতীর ছবি, আর হোটেলগুলির পরিচালনায় মেয়েরাই। ওখানে হোটেল মানে নিজেদের থাকার বাড়ির মধ্যেই একটা বা দুটো ঘর প্রয়োজন অনুযায়ী ভাড়ার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া, যার আজকের পোশাকি নাম “হোম স্টে”। সুবিধা হল পরিবারে না থেকেও পরিবারের সঙ্গে থাকা। কাল থেকেই হাঁটা শুরু। খাওয়া সেরে বেড়িয়ে পরলাম পরের দিনের জন্য মালবাহক বা পোর্টার ঠিক করতে। কিন্তু যে পরিমান জিনিসপত্র আমরা নিয়ে গেছি তাতে কম-সে-কম চারজন পোর্টারের প্রয়জন। হায়! আমাদের বাজেটে তো পারমিট করছে না। এমন সময় স্থানীয় কেউ পরামর্শ দিল ইয়াক ভাড়া করে নেবার। সেই মতো দুটো ইয়াক ভাড়া করা হল। তুলনামূলক ভাবে বেশ কিছুটা সস্তাই পড়ল। আমাদের ট্রেকিং রুট ছিল ‘ইয়কসাম – বাখিম – সোকা – জোংরি – গোয়েচালা – বাখিম – ইয়কসাম’ এই রকম। উপরে যাবার পথে সোকা আর জোংরিতে রাত্রিবাস, আর ফেরার পথে বাখিমে – এরকমই প্ল্যানিং। তাতে তিনটে জায়গাতেই থাকা হবে। রাত্রে খাওয়ার পর ক্যাপ্টেন তাড়া লাগাল তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার জন্য।

আপন পায়ে জোকের সাথে —–

পরের দিন রেডি হয়ে বেড়োতে বেড়োতে সকাল আটটা বেজে গেল। আসলে প্রস্তুতির বহর সাংঘাতিক। জোঁক-এর সঙ্গে মোকাবিলার জন্য ফুল প্যান্টের পা-গুলো মোজার মধ্য ঢুকিয়ে সুতলী দিয়ে বাঁধা। মোজার আর ঘাড়ের কলারের মধ্যে রাখা হয়েছে কলকাতা থেকে আনা দোক্তাপাতা। আর হাতে নেকড়ায় বাঁধা নুনের পুঁটলি যেটা সুতলী দিয়ে পা পর্য্যন্ত ঝুলছে। পিঠে রুকস্যাক চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম জোংরি অভিযানে। পাঠক, ট্রেকিং-এর বাকি দিন গুলো আমাদের বেশবাস একই রকম থাকবে। গলায় ঘন্টি ঝোলানো দুটো ইয়াকের পিঠে সমস্ত রেশন, বাসনপত্র তুলে দিয়ে আমরা পায়ে পায়ে এগোলাম। দুটো ইয়াক দেখভালের জন্য দুইজন কুলি। অনেকটা দূর থেকে ইয়াকের গলার ঘন্টির মিস্টি টং টং আওয়াজ কানে আসে, আর চলার একটা ছন্দ তৈরী হয়। কিছুক্ষণ চলার পর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হল। তবু চলছি – আস্তে আস্তে বৃষ্টির তেজ বাড়ল। পথের শোভা অসাধারণ। যে দিকে তাকাই শুধু সবুজ আর সবুজ। গভীর জঙ্গল আর সরু চলার পথে পথে গুল্ম, লতা-পাতা আর সঙ্গে জোঁক ফ্রী। পথে অনেক বাঙালি ট্রেকার, তবে বিদেশীও কম নেই। ইতিমধ্যে ইয়াকগুলো কখন আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেছে খেয়াল নেই। আমরা পথের সৌন্দর্যেই মশগুল। আমাদের আজকের গন্তব্য বাখিম পেরিয়ে আরও তিন কিলোমিটার এগিয়ে সোকা পর্য্যন্ত। ফেরার সময় বাখিমে থাকব বলে ঠিক করেছি। কোনো তাড়া নেই। দুলকি চালে এগিয়ে চলেছি। অঝোর বৃষ্টি। আবহওয়া স্যাঁতস্যাঁতে। রেনকোটের বাইরেটা ভিজছে বৃষ্টির জলে আর ভিতরে ভিজছি ঘামে। চোখে পড়ল উপর থেকে কিছু পোর্টার অনেক মালপত্র নিয়ে নেমে আসছে। সেই মালপত্রের উপর অনেক সুন্দর সুন্দর চেয়ার, টেবিলও রয়েছে। মনে হচ্ছিল সদ্য কেনা। আর পিছন পিছন সার দিয়ে আসছে শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষ বিদেশীদের এক বিশাল ট্রেকিং পার্টি। ওদের ট্রেকিংয়েও বিলাসিতার কোনো খামতি নেই। অথবা ঝাড়া হাত-পা শুধু হাঁটা টুকুই নিখাদ উপভোগ করবে বলে এই ব্যবস্থা। এসব ভাবতে ভাবতে যখন একটু একটু করে প্রত্যেকে নিজেদের বোঝা নিজেরাই পিঠে নিয়ে এগিয়ে চলেছি, তখন মনে মনে আনন্দও হচ্ছিল এই ভেবে যে উপরে ঘর পেতে মনে হয় খুব বেশী অসুবিধা হবে না। হঠাৎই ছন্দপতন ঘটল। ভারী বৃষ্টির জন্যে রাস্তা পিছল। দেখলাম সামনে আমাদের ক্যাপ্টেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। তখন আমাদের প্রত্যেকের মাথা ঠান্ডা রাখাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। এদিকে জোঁকের আপ্যায়নের জন্য বসার জো নেই। সুতরাং ক্যাপ্টেনের ওই অবস্থাতেও চলা ছাড়া হাতে বিকল্প কিছু চিল না। আমরা কিছুটা সাহায্যের চেষ্টা করেছিলাম বটে, কিন্ত শেষ পর্য্যন্ত ও নিজের মানসিক দৃঢ়তায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হলেও আমার আর তাপসের আগেই সোকায় পৌঁছে গিয়েছিল। আমাদের মধ্যে তাপস মিনোল্টা কোম্পানীর একটা ক্যামেরা বাগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে যাবার জন্য সাসপেনশন ব্রীজ, কখনো বা ঝর্না পার হবার জন্য গাছের গুঁড়ি এইভাবেই পথ চলা ও ছবি তোলা। এই রাস্তায় একটাই সুবিধে জোঁকের জন্য কোথাও বসে বিশ্রাম নেওয়ার উপায় না থাকায় পিচ্ছিল রাস্তায় হাঁটার মজাটা উপভোগ করা যাচ্ছিল। সাধারণত, পাহাড়ী রাস্তায় চারটের পরই অন্ধকার নেমে আসে। ছবি তুলতে গিয়ে আর পোজ দিতে গিয়ে খানিক দেরীও হয়ে গেছিল। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী যথারীতি আমাদের হাতে টর্চ জ্বলে উঠেছিল, আর ধীরে ধীরে আমরা, মানে আমি আর তাপস এগিয়ে চলেছিলাম সোকার পথে। আমাদের পৌঁছনোর বেশ কিছুক্ষন আগেই ক্যাপ্টেন সমীর, ফজল আর শুভাশীষ পৌঁছে গেছে। ট্রেকিং-এর সময় এপথে বা অন্য যে কোনো পথেই সাধারনত কেউ একা একা চলেনা। আর এপথে তো একদমই নয়, কারণ বন্য জন্তু বিশেষ করে ভাল্লুক-এর উপদ্রব খুব বেশি। আমি আর তাপস যখন পৌঁছালাম ততক্ষণে অন্ধকার নেমে এসেছে।

ট্রেকার্স হাটে বিতর্ক —

যাই হোক গিয়ে শুনলাম বেশ ঝামেলা করেই ঘর জোগাড় করতে হয়েছে। ট্রেকার্স হাটে আমাদের কোনমতেই থাকতে দেবে না। এই নিয়ে আমাদের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে ট্রেকার্স হাটের পোর্টার-কাম-কেয়ারটেকারের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত। বিতন্ডা চলার সময় ওদের মধ্যে একজন আমাদের ক্যাপ্টেন সমীরকে আঘাত করার চেষ্টা করেছিল এবং তখন আমাদের পোর্টারও ওদের সঙ্গ দিয়েছিল। কারণটা পরে জানতে পেরেছিলাম। আমাদের পিছনে একটা শ্বেতাঙ্গ দল আসছে, আর ওদের ঘরের প্রয়োজন। সুতরাং আমাদের ঘর দিলে চলবে না। এদিকে সেই দল পৌঁছাতে না পাড়ার জন্য আগের ট্রেকার্স হাটে অর্থাৎ বাখিমেই রয়ে গিয়েছিল। ওম শান্তি ওম ! যাই হোক, কোনো রকমে একটা ঘর পেলাম। সারাদিনের পরিশ্রমের পর এবার আমাদের বিশ্রামের পালা। তখন বাইরে দুর্যোগ চলছে। অঝোরে বৃষ্টি সঙ্গে কনকনে হওয়া। ট্রেকার্স হাটেরর কাঠের মেঝেতে বসেই বিশ্রাম নেওয়া। এই সময় শুভাশিষ পায়ে কিছু অস্বস্তি বোধ করল। জুতো মোজা খুলতেই রক্ত খেয়ে ঢোল দুট জোঁক লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টায় ছিল। কিন্তু লবণ থেরাপির প্রয়োগে আর আমাদের তৎপরতায় সেই জুটিকে নিকেশ করতে বিলম্ব হল না। এদিকে রান্না ঘরটা ছিল কিছুটা দূরে। তাতে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমাদের কাছে স্টোভ চাল ডাল সবই ছিল। সময় নষ্ট না করে খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম। ঘন্টা দুয়েক পর যেটা নেমেছিল সেটা আর যাই হোক খিচুড়ি না বলাই শ্রেয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন, সেটা খেয়ে কারো খিঁচুনি আসেনি অন্তত। প্রত্যেকেই এতটাই ক্লান্ত ও ক্ষুধার্থ ছিল যে সবাই চুপ চাপ সেই খিচুড়ি গিলে নিয়ে ছিল। আমাদের রেশন থেকে পোর্টাররা নিজেদের রান্না নিজেরাই করে নিত। দেখলাম আমাদের হিসাবে একটা ফাঁক রয়ে গেছে। আমাদের রেশনের মধ্যে পোর্টারদের খাবার হিসাবটা ধরা হয়নি। আর তাদের খাবার পরিমানও আমাদের চারগুণ। ফলত পরবর্তী কালে আমাদের খাদ্য সঙ্কট অনিবার্য ছিল।
(চলবে)

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version