ইন্দ্রনীল বসু

আঠারশ শতক ধরে একদল মানুষ ছিল। তাদের পেশা ছিল ডাকাতি। সেসময়ের জাত ডাকাতরা সবাই ছিল শক্তিসাধক। বেশিরভাগই দেবী কালীর ভক্ত। তারা গভীর জঙ্গলে কালীমূর্তি অথবা দেবীর প্রতীক হিসাবে সিঁদুর মাখানো খাঁড়া, গাছের গুড়ি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে জাঁকজমক সহকারে পূজা করত। তাদের পূজা পদ্ধতির একটা নিজস্ব ধারা ছিল। অনেক সময়ই জঙ্গলের মধ্যে পুরোহিত পাওয়া যেত না। তাই তারা নিজেদের মতো করে শক্তির সাধনা করত। ভেড়া, ছাগল বলি হত। এছাড়াও তিথি নক্ষত্র মেনে নরবলিও দেওয়া হতো। ডাকাত যত ভয়ঙ্কর হতো তাদের নরবলির আকাঙ্ক্ষা ততো বেশি দেখা যেত।

সেইসব ডাকাতদের বিশ্বাস ছিল মা কালীর কাছে নরবলি দিলে আসুরিক শক্তি জাগ্রত হয়। সিদ্ধেশ্বরীর দয়ায় ডাকাতি সফল হয়। সেকালের ডাকাতের মধ্যে নামকরা ছিল রঘু ডাকাত, বিশে ডাকাত, মনোহর ডাকাত,বুধ ডাকাত, মাধো ডাকাত ইত্যাদি। এছাড়াও তথাকথিত কিছু জমিদারও ডাকাতি করতেন। দেবি ঘোষ, নবিন‌ ঘোষ, গগন সরদার প্রমূখ ছিলেন জমিদার ডাকাত। বাংলায় সেসময় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অসংখ্য ছোট ও বড় ডাকাত ছিল। বড় বা নামি না হলেও ছোট ডাকাতরাও নৃশংসতায় বড় কম যেত না। ডাকাতরা যেহেতু ক্ষমাহীন আর নৃশংস, তাই তাদের কালী প্রতিমাও হত ভীষণ দর্শনা। কষ্টি পাথরের কালো মূর্তি, লাল জিভ, এলোকেশী, হাতে খড়গ, গলায় মুন্ডুমালা। দেখলেই ভয় হত লোকের। এই সব ডাকাতদের তখনকার দিনে আবার ডাকাতির এলাকা থাকত। জাত ডাকাতরা হটাৎ এসেও হাজির হতো না। আগে ধনী বা বড় মানুষের বাড়ি খবর দিয়ে, কালী পূজো সেরে ডাকাতি করতে আসত তারা। দূর থেকে মশাল জ্বালিয়ে হা রে রে রে ডাক পারতো সে সব ডাকাত দল। মেয়ে মানুষদের গায়ে হাত দিত না তারা। তবে পুরুষ বা জমিদারের লেঠেল যাদের সামনে পেত তাদের কচুকাটা করে টাকা , গয়না লুঠ করে নিয়ে যেত।

সে কি আর আজকের কথা! আজ থেকে ৩০০ -৪০০ বছর আগেকার গল্প-কাঁথা।’ সেসময় নামকরা ছিল রঘু ডাকাত। আর তার আরাধ্য দেবী ছিলেন সিদ্ধেশ্বরী। তার দলের প্রত্যেককেই কালির উপাসক। ডাকাত যেমন রহস্যময় তার আরাধ্য দেবীও তেমনই। বহু জায়গাতেই শোনা যায়, এটা রঘু ডাকাতের কালী। যেমন এখনকার কাঁচড়াপাড়ায় বীজপুর থানার কাছে আছে একটি কালী মন্দির। সেটিকেও লোকে বলে রঘু ডাকাতের কালি। সে সময় এই অঞ্চলটি ছিল ঘনও অরণ্যে পরিপূর্ণ আর ছিল ডাকাতের আস্তানা। এখানে যে দেবী মূর্তি রয়েছে, সেখানে একটি প্রাচীন নিম গাছ ছিল। সেই গাছটিকে ডাকাতরা সিঁদুর চন্দন দিয়ে কালী জ্ঞানে পুজো করত। কথিত আছে, বহু অসহায় মানুষদের নিয়ে এসে নিমগাছটি তলায় বলি দিত। অনেকে বলে থাকেন স্বয়ং রঘু ডাকাত না হলেও তার সাকরেদদের আস্তানা ছিল এখানে। পরবর্তীকালে ডাকাতরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও বা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম ডাকাতি ছেড়ে দিলেও, সেই নিম গাছের মাহাত্ম্য কমে নি এতটুকু। পরে নিম গাছটি কাটা পড়লেও তার পাশে গড়ে ওঠে কালীমন্দির।

রঘু ডাকাতের মতোনই ভয়ঙ্কর এবং দুর্দান্ত ছিল মনোহর ডাকাত। আজকের কলকাতার অভিজাত এলাকা মনোহরপুকুর এই মনোহর ডাকাতের নামে তৈরি বলে দাবি। সেসময়, প্রায় আড়াইশো- তিনশো বছর আগে এলাকাটি ছিল পুরো জলাজঙ্গলে পূর্ণ। খাল-বিল, হোগলার বন। পথে-ঘাটে শিয়াল আর বাঘ ঘুরে বেড়াতো। লোকের বসতি খুব কম। এদিকে একটা ছোট খালের মধ্যে দিয়ে চলত নৌকা। সুন্দরবনের যাত্রীরা কাঠ কাটতে, মধু সংগ্রহ করতে আর শিকার করতে যেত এই পথ দিয়ে। জেলে, বাগদি, বাউরি আর জংলি মানুষেরা থাকতো এই অঞ্চলে। জঙ্গলের গভীরে থাকতো ডাকাতদল। আর এই ডাকাত দলের সর্দার ছিল মনোহর বাগদি।

এই পথে সেকালে কালীঘাটের কালী দর্শন করতে আসতেন পুণ্যার্থীরা। আসতেন দলবেঁধে। থাকতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নারী ও শিশু। আদিগঙ্গা দিয়ে নৌকা করে নিবিড় বনের হাঁটা পথ দিয়ে তারা আসতেন। ডাকাতদলের শিকার ছিলেন এরাই। মনোহর এর বাড়ির অদূরে ছিল ছোট একটা ভাঙ্গা মন্দির। মন্দিরে পাষাণী কালী মূর্তি। মূর্তি আকারে ছোট হলেও অতি ভীষণ দর্শনা। ডাকাতরা এই কালী মূর্তির নাম দিয়েছিল কঙ্কাল মালিনী। কোন অলংকার ছিল না সেই মাতৃমূর্তির অঙ্গে। দেবী ছিলেন আয়ুধ ভূষিতা। মুণ্ডমালা বিভূষিতা। তার হাতে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল নরবলির একটি মুণ্ড। নিত্য পূজা হত। ছাগল, মহিষ বলি হতো। আর পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় হত নরবলি।

একবার হলো কি ডাকাতি করে ফেরার পথে মনোহর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা একটি শিশুকে রাস্তায়
পড়ে থাকতে দেখলেন। সঙ্গে স্ত্রীলোকটি তার মা ছিলেন। কিন্তু বাঘের আঘাতে স্ত্রীলোকটি মৃত্যু হয়। মনোহর শিশুটিকে বড় করে তোলেন। নাম রাখেন হারাধন। মৃত্যুর সময় মনোহর এই হারাধনকে তার মাটিতে পোঁতা সমস্ত ধনরত্ন দিয়ে যায়। আর উপদেশ দিয়ে গেল আর বলে গেল, গরিব-দুঃখীদের দেখবি। আজ মনোহর নেই হারাধনও নেই। কিন্তু মনোহরের নামে হারাধন যে পুকুর কাটিয়েছিলেন, সেটি এখন মনোহরপুকুর রোড নামে পরিচিত। আর পূর্ণ দাস রোডে ডাকাতে কালীর মন্দিরটি এখনো রয়েছে।

সে রকমই আরেক আকর্ষণীয় কাহিনী চিতপুরের চিত্তেস্বর রায় ওরফে চিতু ডাকাতের। যদিও চিতু ডাকাতের আর আরাধ্যা দেবী কালি ছিলেন না। চিতু ডাকাত পূজা করতেন মা দুর্গাকে। ষোড়শো উপাচারে সে পুজো হত। তার পরই চীতু যেতেন ডাকাতি করতে। ডাকাতি করার আগে গৃহস্থ কে চিঠি দেওয়া হত। প্রস্তুত থাকতে বলা হত। তারপর নির্দিষ্ট দিনে মায়ের সামনে নরবলি দিয়ে পুজো করে ডাকাতি করতে যেত চিতু ডাকাত। সে সময় ঘন জঙ্গলে আবৃত ছিল চিত্রপুর। মুঘল বাদশাহ এর আমল থেকেই এই পথের অস্তিত্ব। এই পথের দু’ধারে ছিল গভীর জঙ্গল। বর্তমানে যেখানে গান এন্ড সেল ফ্যাক্টরি তার উল্টো দিকে অবস্থিত ছিল ডাকাতের আরাধ্যা দেবীর মন্দির। এই দুর্গা দেবীর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এখানে বাহন সিংহের সঙ্গে একটি বাঘও রয়েছে। দু’পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক গণেশ অনুপস্থিত। আসলে ঐসময় এই জঙ্গল বাঘের আবাসস্থল ছিল। তাই বাঘকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বোধহয় ডাকাত বাঘের পুজো করতো। এখন যেমন সুন্দরবন অঞ্চলে দক্ষিণ রায় ও বাঘের পুজো একত্রে হয়। ডাকাতের মা দুর্গা মাটি দ্বারা নির্মিত নয়, গঙ্গা থেকে তুলে আনা নিম কাঠ দিয়ে ডাকাত তার আরাধ্যা দেবী মূর্তি নির্মাণ করেছিলেন।

চিতু ছাড়াও স্থানীয় লোকের পূজা পেতেন চিতু ডাকাতের দুর্গা। তখন নবাবী আমল। একবার নবাবের সেনাপতি চক্রপাণি দত্ত লোকলস্কর নিয়ে চিত্তেশ্বরীকে পুজো দিতে আসেন। সেইসময়ে চিতু ডাকাত মায়ের পুজো করছিলেন। সেদিন মায়ের সামনে নবাবের সেনার সঙ্গে ডাকাতের প্রবল লড়াই হয়েছিল। সেই লড়াইয়ে বহু রক্তপাতের পর নবাব সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন চিতু। বিচারে তার প্রাণদণ্ড হয়। চিতু ডাকাতের মৃত্যুর পর মা দুর্গার বিগ্রহ জঙ্গলে একাকী পড়ে রইলেন। তার পূজা পাঠ বন্ধ হল। এরপর আবার মন্দির সংস্কার করে মায়ের পূজা শুরু করেন নৃসিংহ ব্রহ্মচারী নামে এক তান্ত্রিক সাধু। মায়ের মূর্তি উদ্ধারের সময় নৃসিংহদেব দেবীর চরণে লেখা দুটি শ্লোক দেখতে পান। তিনি সেই শ্লোক উচ্চারণ করেই দেবীর পুজো করেন এবং এখনও সেই গুপ্তমন্ত্র চিত্তেশ্বরী মায়ের পূজা হয়।

খোদ কলকাতা শহরে ডাকাতদের নামে এবং প্রতিষ্ঠা করা কালী মন্দির ও রাস্তা এখনও রয়েছে। মনোহর পুকুর রোড ছাড়াও রসা রোড , বৌবাজার এলাকার গলাকাটা গলি এবং কসবার রামলাল বাজার সবই সেই সব ভয়ঙ্কর ডাকাতদের নামাঙ্কিত যা এখনও ডাকাতি , কালীপুজো, তন্ত্র সাধনা আর ভয়াবহতার কথা আমাদের স্মরণ করায়।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version