ডাক্তারি পড়াকালীন দেশে কলেরা মহামারি দেখা দেওয়ায় বছরখানেক তিনি ডাক্তারিতেই মন দেন।কিন্তু কঠিন পরিশ্রমের ধকল তাঁর দুর্বল শরীর সামলাতে পারেনা। তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। সারাজীবন এই রোগ তাঁকে বেশ ভুগিয়েছে। কিন্তু ততদিনে তিনি লেখক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছেন। ফলে বাকি জীবনটা কলম চালিয়েই পার করেন। এরই মধ্যে বছর কয়েক গ্রামেও বসবাস করেছেন। নাটক আর ছোটগল্প লিখে খ্যাতির গগনে পৌঁছলেও শারীরিক অসুস্থতা তাঁর পিছু ছাড়েনি। শেষ জীবনেএক রূপসী অভিনেত্রীকে বিয়ে করেন।তাঁর অভিনেত্রী স্ত্রী অভিনয়ের পাশাপাশি স্বামীর খেয়াল রাখতেন।

তিনি লিখেছেন খুব অল্প। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে তাঁর ছোটগল্প আজও অতুলনীয়। তাই তাঁর লেখার ধরণ কিংবা কোথায় তিনি স্বতন্ত্র তা নিয়ে ভাবতে হয়। যদি এভাবেও দেখা হয় যে বিশ্বসাহিত্যে প্রচলিত ছোটগল্পের একটি মডেল হাজির করেছিলেন মপাসাঁ। যার গল্পের শেষে একটা ক্লাইম্যাক্স পাওয়া যায়। সমস্ত বর্ণনা, কীর্তিকাহিনী গল্পটিকে সেই ক্লাইম্যাক্সের দিকে নিয়ে যায়। সেটাই কি ছোটগল্পের জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু তাঁর গল্প ক্লাইম্যাক্স-শূন্য, নিস্তরঙ্গ, অথচ খুবই বাস্তবমুখী সমস্যা কেন্দ্রিক। তাঁর গল্প পড়ে অনেক সময়েই মনে হয় আমাদের জীবনে খুব বেশি ক্লাইম্যাক্স নেই। বেশিরভাগ ঘটনাই সাদামাটা, বিশেষত্ববিহীন। তাহলে তাঁর মুন্সিয়ানা কোথা? এই সাদামাটা, বিশেষত্বহীন জীবনকেই তো তিনি তাঁর ছোটগল্পে জায়গা দিয়েছেন। ক্লাইম্যাক্স ছাড়াই সার্থক ছোটগল্প লিখেছেন। অন্যথা কি ঘটেনি। কিন্তুতাঁর গল্পের ক্লাইম্যাক্স জীবনমুখী ও স্বাভাবিক। পড়ে চমক লাগে না, কিন্তু গল্পগুলি অসাধারণত্ব পায়।

তাঁর গল্পে তেমন কোনো মোচড়ও লক্ষ্য করা যায় না। কিন্তু গল্প বোনার কৌশল আর তার মুনশিয়ানায় গল্পের প্রতিটি চরিত্র এতটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে যে পড়তে পড়তে আমরা এমন এক অবস্থায় পৌঁছে যাই, যেখানে পুরো আখ্যানটিকে বাস্তব বলে মনে হয়।অথচ ঘটনা অতিসাধারণ, চরিত্রও সাধারণ, কিন্তু হয়ে ওঠে অসাধারণ, চরিত্রগুলিও হয়ে ওঠে জীবন্ত। চরিত্রগুলি নিজেই গল্প বলে, এমন ভাবে বলে, এমন আচরণে করে যাতে লেখকের উপস্থিতি ঢাকা পড়ে যায়। মনে হয় লেখকের কল্পনাশক্তির কোনো ছাপ নেই; বাস্তবে এমনটাই ঘটে থাকে। কয়েকটি গল্পে চোখ বোলালে এই ধারণাগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।

ডাক্তারি পড়ার খরচ চালাতে যিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন দু’বছরের মধ্যেই তাঁর প্রায় ৬০টি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। যে কারণে তিনি বলতেন, ‘ঘর করছি ডাক্তারির সঙ্গে আর প্রেম করছি লেখালেখির সঙ্গে।’ আবার তারই বই প্রকাশ হতে লেগে যায় ১৩৭ বছর। যে বইটি তিনি অতগুলি বছর আগেই লিখেছিলেন। বেশ কিছু বিতর্কিত বিষয় থাকায় বিংশ শতকে কোনো প্রকাশক তখন বইটি ছাপতে চাননি। রাশিয়ায় একাধিক প্রকাশকের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তারাও তখন ছাপতে রাজি হননি। পরবর্তীতে প্রকাশ করে দ্য নিউইয়র্ক রিভিউ অব বুকস। বইটির নাম ‘দ্য প্রাংক’। এই বইটিতে রয়েছে বেশকিছু রম্য রচনা, স্কেচ ও ছোটগল্প।

১৮৮২ সালে তিনি সিদ্ধান্ত নেন লেখক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছোটগল্পের একটি সংস্করণ তৈরি করবেন। সেই জন্য নিজের লেখা ছোটগল্পগুলি থেকে ১২টি গল্প বেছে তৈরি করেন পাণ্ডুলিপি, যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তাঁর ভাই। বইটি সম্পর্কে নিজের এক বন্ধুকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার সেরা গল্পগুলি এই বইতেই আছে।’ গল্পগুলি বিদ্রূপাত্মক রচনা, ছাত্রজীবন, শৈল্পিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, পারিবারিক টানাপড়েন, ভালোবাসা এবং বিশ্বাসঘাতকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। বইটি লেখক বেঁচে থাকাকালীন প্রকাশিত হয়নি। মাত্র ৪৪ বছর বয়সে লেখক মারা যান। অসংখ্য ছোটগল্পের এই রূপকারের নাম আন্তন পাভলোভিচ চেখভ। চেখভের লেখা উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে- অন দ্য হাই রোড, দ্য চেরি অর্চার্ড, থ্রি সিস্টার্স, দ্য সিগাল, দ্য ওয়েডিং, আ ম্যারেজ প্রোপোজাল, দ্য বিয়ার, ইভানভ ইত্যাদি।

চেখভ তার সাহিত্যিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যদিও এর থেকে তিনি সামান্যই উপার্জন করতেন। তিনি অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা করতেন বিনামূল্যে। তাই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আসতো তার লেখালেখি থেকে। তিনি লেখালেখি মুলত শুরু করেছিলেন টাকা উপার্জনের জন্য। একজন মানুষের কতটুকু জমি দরকার তা টলস্টয় তাঁর ছোট গল্পে জানিয়েছিলেন। কিন্তু চেখভ টলস্টয়কে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তিনি বলেছেন কাঁধ ঝাকিয়ে মানুষের দরকার তিনহাত জমি?  কখনো নয়। সেতো  মৃত মানুষের জন্য। জীবিত মানুষের জন্য তিন হাত জমি কখোনই নয়,  নিছক তালুকও নয়, তাঁর চাই পুরো পৃথিবী। তবেই মানুষ হিসেবে পূর্ণ চরিত্র ও গুনাবলীর বিকাশ ও স্ফুরণ ঘটা সম্ভব।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version