আমাদের দেশের ৮৫ শতাংশ জল ব্যবহৃত হয় চাষাবাদে, কল কারখানার জন্য ১০ শতাংশ,বাকি ৫ শতাংশ জল ব্যবহৃত হয় গৃহস্থালীর কাজে। সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, বর্তমানে নির্ভরযোগ্য যে সব উৎস থেকে দীর্ঘস্থায়ী ভিত্তিতে মিষ্টি জলের যে যোগান রয়েছে, কয়েক বছরের মধ্যে তার চাহিদা বেড়ে গিয়ে দাড়াবে প্রায় ৪০ শতাংশ। ইতিমধ্যেই দেশে মাথাপিছু জলের যে জোগান রয়েছে তাতে বেশ টানাটানি পড়েছে। এই ভাবে আর কিছুদিন চললে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে বিরাট একটা জলসংকট তৈরি হবে। জলের তীব্র সংকট মানেই পানীয় জলের জন্য হাহাকার বাড়বেতো বটেই তাছাড়াও জলবাহিত অসুখ বিসুখ যেমন বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাবে। জলের এই অবস্থা বিশ্লেষণ করেই বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, দেশে নিরাপদ পানীয় জলের জোগানের সম্ভাবনা ক্রমশ কমছে। পরিস্থিতি দিন দিন এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ছে যে আগামী ৭-৮ বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশ ভারতীয় পানীয় জলটুকুও পাবেন না।

এনআইটিআই ( NITI )আয়োগ-এর রিপোর্ট অনুযায়ী কয়েক বছরের মধ্যে ১০ কোটি ভারতবাসী ভূগর্ভস্থ জলের অভাবে তীব্র জলসঙ্কটে ভুগবেন। দিল্লি, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদের মতো ২১টি শহরের ভূগর্ভস্থ জলও ফুরিয়ে যেতে পারে এক বছরের মধ্যেই। ইতিমধ্যেই চেন্নাই-সহ তামিলনাড়ুর বিস্তৃত অংশে তীব্র জলসংকট দেখা দিয়েছে। এই অবস্থার উন্নতি না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ৪০ শতাংশ মানুষ পানীয় জলটুকুও পাবে না।কম্পোসিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনডেক্স-এর রিপোর্ট বলছে, দেশে প্রতিদিন দূষিত জল পান করে গড়ে ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। জলসঙ্কট তীব্র হলে সংখ্যাটা আরও বাড়বে।

কেন এই জলসঙ্কট? আমাদের দেশে ৫০ শতাংশেরও বেশি জমি চাষের জন্য ব্যাবহার করা হয়। তার মানে আমরা ৫০ শতাংশের বেশি জমি কর্ষণ করি এবংসেটা খুবই অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে।কিন্তু যদি চাষাবাদ আরও বেশি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয় তাহলেমাত্র তিরিশ শতাংশ জমি থেকেই গোটা দেশবাসীর খাদ্যের যোগান দেওয়া যায়। কিন্তু এখনও সেই কয়েকশো বছর আগের পদ্ধতি চলছে। যে পদ্ধতিতে এককেজি চাল উৎপাদন করতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লিটারের বেশি জল লাগে। অথচচীনে প্রায় তার অর্ধেক জলেই উৎপাদন হয় দ্বিগুন। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রচুর কৃষিবিজ্ঞান ওপ্রযুক্তির চর্চা হচ্ছে, বিশেষজ্ঞরাও গবেষণা চালাচ্ছেন কিন্তু জমিতে তার আঁচ পৌঁছচ্ছে না।

চল্লিশ বছর আগে দেশের রাসায়নিক সার উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি গ্রামে গ্রামে প্রচার করল, কৃষিজমি থেকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলতে হবে কারণ, ওই সব গাছের শিকড়বাকড় সব সার খেয়ে ফেলে। চাষিরাওতাই শুনে চাষের জমি থেকে লক্ষ লক্ষ গাছ কেটে ফেললো। আজ দেশের প্রত্যেকটি জলের উৎস- মাটির নীচের জল, নদীর জল, সবই প্রায় নিঃশেষ। বিগত ১00 বছর ধরে এই উপমহাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় একই রয়েছে, মাটির জল ধারণ করার ক্ষমতাও গিয়েছে কমে। কারণ সবুজের ঘনত্ব কমে গিয়েছে। বৃষ্টি আসে কিন্তুজল বয়ে যায় এবং বন্যা দেখা দেয়। বর্ষা শেষ হওয়ার পর আসে শুখা।

ভূগর্ভের সঞ্চিত জল দ্রুত গতিতে কমছে কারন, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের জন্য বড়ো বড়ো পাম্প বসিয়ে বেশি বেশি জল তোলা হচ্ছে। একইভাবে কৃষিকাজেও ডিজেল পাম্প ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণে জল টেনে নিয়ে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ান হচ্ছে ক্রমবর্ধমান মানুষের জন্য। প্রচুর পরিমাণে ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ায় সঞ্চয় কমছে, কিন্তু সমপরিমাণে পূরণ হচ্ছে না, কেননা মাটির উপরের জল নানাভাবে অপচয় হচ্ছে। যেসব জলাশয়, হ্রদ বা প্রস্রবণ ভূগর্ভস্থ জল পায়, সেগুলো ক্রমশঃ শুকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী কয়েক বছরেভূগর্ভস্থ জলের চাহিদা এবং প্রয়োজনের তফাত হবে ৫০ শতাংশ। তার মানে প্রয়োজনের অর্ধেক মাত্র ভূগর্ভস্থ জল পাওয়া যাবে মাটির নীচ থেকে।

বৃষ্টির জল হল মিষ্টি জলের উৎস।কিন্তু আধুনিকীকরণের নামে সেই বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ঐতিহ্যশালী পন্থাগুলো আমরা ধ্বংস করে ফেলেছি। অথচ পশ্চিম রাজস্থানে বছরে মাত্র ১৩০ মিলিমিটার বা তারও কম বৃষ্টি হলেওসেখানকার মানুষ জলের কষ্টে ভোগে না। কারণ তারা প্রতিটা ফোঁটা বৃষ্টির জল জমা করে রাখতে জানে।

আমাদের দেশের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৬০ কোটি মানুষের জন্য বিশুদ্ধ পানীয় জলের কোনো বন্দোবস্ত নেই৷ ঔরাঙ্গাবাদে মানুষ ট্রেনে চেপে ১৪-‌১৫ কিলোমিটার দূরে যায় পানীয় জল কিনতে। দেশে মোট ১৮ শতাংশ মানুষ পাইপলাইনে পানীয় জলের পরিষেবা পান৷ কয়েক বছর ধরেই মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, কেরালা ও গুজরাটসহ বিভিন্ন রাজ্যে পানীয় জলের গভীর সংকট দেখা দিয়েছে৷ এমনকি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আর্সেনিক ও ফ্লোরাইডের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে৷ এখনও বৃষ্টির জল ধরে রেখে পানীয় জল জোগানোর ব্যবস্থা না করলে সমস্যা আরেও বাড়বে৷
Share.

3 Comments

  1. Pingback: আগামী দিনে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের পানীয় জলও মিলবে না

  2. খুব ভাল আর দরকারী লেখা। পশ্চিমবঙ্গে বিশেষত দক্ষিণ বঙ্গে, এত এত জল দেখে আমরা এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝি না। অথচ দক্ষিণ বঙ্গে ভূগর্ভস্থ জল কমে যাওয়ার ফলে অন্য রকম সমস্যার উদ্ভব হতে পারে। সেসব নিয়েও কথা হওয়া দরকার।

Leave A Reply

Exit mobile version