তিনি ৪০ বছরের সঙ্গীত জীবনে ৮ হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেছেন, তামিল, তেলেগু, মালায়লাম, কন্নড় এবং হিন্দি ছবির সুরকার তিনি। তাঁকে একজন কিংবদন্তির চেয়েও বেশি কিছু বলা যায়। তিনি কেবল দক্ষিণ ভারতীয় নন, এই মহাদেশের সহস্রাব্দের সঙ্গীত প্রতিভা। প্রেক্ষাপট তামিল হলেও তাঁর সঙ্গীত প্রায়শই রাজনৈতিক বার্তা বয়ে আনে যা সামাজিক একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে। ভাষাগত ফারাক থাকলেও তা আঞ্চলিকতার বেড়া টপকে সেই সঙ্গীত নান্দনিক। তাঁর সঙ্গীত সুখ থেকে দুঃখ, রাগ-রাগিণী থেকে শান্তি অশান্তির মতো নানা আবেগকে অর্থবহ করে তোলে। যে বিস্তৃত সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর সঙ্গীত পরিবেশিত হয়, তা সম্প্রদায় এবং গোষ্ঠীগুলির পরিচয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক অর্থ প্রদান করে।

সঙ্গীত কিংবদন্তি ইলায়ারাজা তামিল সিনেমা দুনিয়ায় কাঠামোগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে অসাধারণভাবেই সফল আর সেটি তাঁর প্রথম পরিচয়। অতি সাধারণ পটভূমি, পিছিয়ে থাকা গ্রাম্য প্রেক্ষাপট থেকে দৈনন্দিন জীবন-উপাদানকে তিনি সিনেমায় তুলে ধরেন তাঁর সঙ্গীতের জাদু বুননে। তাই তাঁর সঙ্গীতকে সমাজতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে আলোচনা করা যায়। ইলিয়ারাজার সঙ্গীত পরিবেশনা সমাজের শ্রমিক শ্রেণী, গ্রামীণ জনসাধারণ এবং তাদের জীবনযাত্রার প্রতি এতটাই মনোযোগী যে তাদের আবেগ, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ, উদ্বেগ এবং সংগ্রাম অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। উদাহরণ দেওয়া যায় ১৯৮৯ সালে গঙ্গাই আমরন পরিচালিত ‘কারাকাত্তাকরণ’ ছবির ‘পাত্তালে পুথি সোন্নার’ গানটির। গানে, ‘এজাইকালুম ইয়েভাল আদিমাইগালাই ইরুপ্পাধাই পদ সোন্নারগাল’ অর্থাৎ তারা আমাকে গরীবদের পরিশ্রম এবং দাস হিসেবে জীবনযাপনের গান গাইতে বলেছে। ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে ইলিয়ারাজা তামিল সিনেমায় যে নতুন ধারণার সুচনা করেন তাতে এমজি রামচন্দ্রন, শিবাজি গণেশন প্রমুখের তারকাকেন্দ্রিক সিনেমা-গঠন ভাঙতে শুরু করেছিল। দ্রাবিড় সিনেমা প্রায় অন্য ধারায় পৌঁছতে চেষ্টা করে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৫- এই সময়টায় কিছুটা হলেও বাস্তববাদী এবং ভাবাবেগ-বিরোধী আখ্যানের এক নতুন ধারার সূচনা হয়। একজন সঙ্গীত পরিচালক হয়েও ইলিয়ারাজা এমন একটি পরিবর্তন আনার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিলেন। যাকে খাঁটি গ্রামীণ জীবনের প্রতিনিধিত্ব বলা যায়।

সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে তাঁর প্রথম ছবি ‘আন্নাকিলি’ (১৯৭৬, প. দেবরাজ মোহন), যে ছবির গানগুলি ছিল লোকগাথা, কেবল তাই নয়, সেই ছবি সিনেমা সঙ্গীতের ধরণ-ধারণকে বদলে দিয়ে ইলিয়ারাজা ভারতীয় সিনেমা সঙ্গীতে বিপ্লব এনেছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় সিনেমায় ধ্রুপদী সঙ্গীত, পশ্চিমী ধ্রুপদী সঙ্গীত এবং তামিল লোকসংগীতের সন্নিবেশ ঘটান। তার সঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল অর্কেস্ট্রেশন, যা তামিল সিনেমায় ছিলই না। তামিল একাধিক ছবিতে তিনি কর্ণাটক সঙ্গীতের স্পষ্ট আভাষ দক্ষতার সঙ্গে পরিবেশন করেন।

জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ভারতীরাজা পরিচালিত ‘কধল ওভিয়াম’, ১৯৮২), (কে বালচন্দর পরিচালিত ‘সিন্ধু ভৈরবী’, ১৯৮৬), ( কে বিশ্বনাথ পরিচালিত, কমল হাসান অভিনীত ‘সালঙ্গাই অলি’, ১৯৮৫) এবং ( কে বালচন্দর পরিচালিত, চিরঞ্জীবী অভিনীত ‘রুদ্রবীনা; ১৯৮৮) ছবিগুলিতে ইলিয়ারাজা অজানা-অপরিচিত রাগ-রাগিণীও ব্যবহার করেছেন। চলচ্চিত্র ইতিহাসবিদ থিওডোর বাসকরণের মতে, তামিল দর্ষক-শ্রোতাদের ইলিয়ারাজা সঙ্গীতের এক নতুন জগতে, এক ভিন্ন অভিজ্ঞতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কর্ণাটক সঙ্গীত গায়ক টিএম কৃষ্ণ বলেন, ইলিয়ারাজা “কর্ণাটক রাগ”-এর উপর ভিত্তি করে অনেক সুর রচনা করেছিলেন এবং জটিল সুরের সঙ্গে সেগুলিকে সংযুক্ত করেছিলেন। তিনি ‘পুনকধবে’ (নিঝালগল, ১৯৮০) এবং ‘আনন্দরগম’ (পান্নীর পুষ্পাঙ্গল, ১৯৮১) এর মতো গানের উদাহরণ দিয়েছেন যা ভারতীয় সিনেমা সঙ্গীতে একেবারেই অপ্রচলিত ছিল। যদিও এমএস বিশ্বনাথন এবং টি কে রামমূর্তি-র মতো সুরকাররা ১৯৬০-এর দশকে কর্ণাটকী রাগগুলিকে সুরের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু তাদের যন্ত্রসঙ্গীতে পশ্চিমী ধ্রুপদী ছিল না।

দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র এবং সংস্কৃতির গুরুত্ব আমাদের সবসময়েই বিস্মিত করে। তামিলদের গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জনপ্রিয় সংস্কৃতি এবং গণআন্দোলনের তাৎপর্য বোঝা। তামিলনাড়ুর সংস্কৃতি সম্পর্কে সারা ডিকের লেখা বই “সিনেমা অ্যান্ড দ্য আরবান পুওর ইন সাউথ ইন্ডিয়া” আরও স্পষ্ট ধারণা দেয়। এটি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আরও এক ধরনের গবেষণার পথ প্রশস্ত করে। এমজিআর, রজনীকান্ত, চিরঞ্জীবী সকলেরই যেমন বিরাট সংখ্যক মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন, তেমনি তারা নানা দিক অনুপ্রাণিতও করেছে। যেখানে সিনেমা সংস্কৃতির ঐতিহ্য শক্তিশালী, সেখানে কিছুটা অবাক করার মতো বিষয় হল, একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং একজন শিল্পী হিসেবে ইলিয়ারাজার একই রকম প্রভাব রয়েছে। তাঁর উপস্থিতিকে সিনেমার তারকা হিসাবে ক্যারিশম্যাটিক রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এখানে আরেকটি নাম এসে পড়ে, তামিলনাড়ুর প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী করুণানিধির। তামিল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রথমবার বিপুল উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল “পরশক্তি” ছবিতে করুণানিধির নাম পর্দায় হাজির হওয়ায়। একইভাবে ১৯৭০ থেকে ১৯৮০-র দশকেও ইলিয়ারাজার নাম পর্দায় ভেসে উঠলে দর্শকেরা বিপুল করতালি ও নানা শব্দে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত। তাই তিনি সুপারস্টার সঙ্গীত পরিচালক এবং বিপণনযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছিলেন। প্রযোজক, পরিচালকরা তাঁকে পেতে লাইনেও দাঁড়াতেন। প্রায় চার দশক ধরে তাঁর মতো করে সিনেমা দুনিয়ায় এতটা আধিপত্য বিস্তার কেউ করেননি। কেবল তাঁকে মনে রেখেও কয়েকটি সিনেমা তৈরি হয়েছিল। তাঁর প্রতিটি শততম ছবি কৃতিত্বের সঙ্গে তাঁর নামে চিহ্নিত করা হয়েছিল, ১০০তম ছবি ছিল ১৯৮০ সালে মুদুপানি, ৪০০তম ১৯৮৭ সালে নয়াগান, ৫০০তম ১৯৯০ সালে অঞ্জলি এবং ১০০০তম ছবি থারাই থাপ্পাট্টাই ২০১৬ সালে।

তাঁকে মনে রেখে অসংখ্য ছবির কথাও লেখা হয়েছিল, যেমন ‘সঙ্গীতা মেগাম’ (উধয় গীতাম, ১৯৮৫) গানটিতে তার তারকাখ্যাতি তুলে ধরা হয়েছিল, ‘নালাই এন গীতামে এঙ্গুম উলাভুমে, এন্ড্রুম ভিঝাভে এন ভানিলে’ (আগামীকাল আমার সুর বিশ্বকে শাসন করবে এবং এটি সর্বদা আমার আকাশের নীচে একটি উৎসব); ১৯৮৮ সালের ‘ভালাইয়োসাই’ গানটিতে একটি লাইন রয়েছে ‘রাগাঙ্গাল থালাঙ্গাল নুরু রাজা উন পেরুম সোল্লুম পারু’ (শতশত রাগ এবং সন্ধান তোমার নাম করবে) এবং ‘মাদাই থিরান্থু’ (নিজলগাল, ১৯৮০) তার সংগীত চিত্র হিসাবে রচিত এবং চিত্রায়িত হয়েছিল। যাইহোক, এই তালিকার শীর্ষে ছিল ‘রাজা রাজাধি রাজন ইন্ধা রাজা’ (এই রাজা শুধু একজন রাজা নয়, রাজাদের রাজা) গানটি (অগ্নি নটথাথারাম, ১৯৮৮) যা শুধুমাত্র তাঁর জন্যই লেখা হয়েছিল।
(চলবে)
