(দুই)
ইলিয়ারাজার সঙ্গীত প্রতিভাকে নানাজনে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন টিএম কৃষ্ণ মনে করেন, “দেশের কোনো সিনেমার গানের সুরকারেরই তাঁর মতো সঙ্গীত বোঝাপড়া এবং উপস্থাপন ক্ষমতা ছিল না, সে সঙ্গীত নির্মানের হোক অথবা শিল্পের। তিনি যে ধরণের সঙ্গীত রচনা করেছেন তা অবিশ্বাস্য”। সমালোচক সদানন্দ মেনন বলেন, “ইলিয়ারাজার সঙ্গীত অনেক সাংস্কৃতিক চিহ্নের সঙ্গে ঘনিষ্ট। তাঁর সঙ্গীত তৈরির পর তাকে যে ফ্রামের মধ্যেই বসানো হোক না কেন তার মধ্যে সাংস্কৃতিক ভাবনা সহজেই খুজে পাওয়া যায়, তা শাস্ত্রীয় হোক বা আধা-শাস্ত্রীয় হোক বা লোকজ হোক”। সমালোচক বা বিশেষঙ্গদের বক্তব্য অনুযায়ী, ইলিয়ায়ারাজা সঙ্গীতকে যে ভাবে হাজির করেছিলেন, তা সাংস্কৃতিক চিহ্ন হিসাবে কাজ করেছিল। তাঁর সঙ্গীত সাংস্কৃতিক পণ্য হয়ে উঠলেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি একথা বলতেই হয় যে তিনি সঙ্গীত রচনার নিয়ম পরিবর্তন করে নতুন মাত্রা এনেছিলেন। তিনি গ্রামীণ ও লোকজ উপাদানগুলি মিশিয়ে সৃজনশীল শৈল্পিক স্বাদের একটি তাজা, সরল তরঙ্গের পথ প্রশস্ত করেছিলেন। যদিও তাঁর পূর্ববর্তী প্রজন্মের সঙ্গীতেও শ্রমিক ও কৃষকদের দুর্দশার কথা ছিল, কিন্তু তা ইলিয়ারাজার মতো গুণমান লাভ করেনি। থিওডের বাসকরণ বলেন, লোকসঙ্গীত আগেও ব্যবহৃত হয়েছে, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে বেশ কার্যকরীভাবেী ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু ইলিয়ারাজা সঙ্গীতকে আত্মার সঙ্গে, মাটির সঙ্গে মিশিয়ে মূল বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি থারাই এবং থাপ্পাটাই (প্যারাই ড্রামস)-এর মতো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন, যা ঐতিহ্যগতভাবে বিবেচিত হত না।

এখানে দুটি গানের কথা উল্লেখ করাই যায় যা দক্ষিনের তামিল-তেলগুভাষী রাজ্যের বামপন্থী এবং দলিত কর্মীদের অনুপ্রাণিত করেছে এবং নানা বিক্ষোভ ও প্রতিবাদী অনুষ্ঠানে জনপ্রিয়তার কারণেই গাওয়া হয়েছে। প্রথম গানটি শ্রীধর রাজন পরিচালিত ‘কান সিভান্থাল মান সিভাক্কুম’, ১৯৮৩; বাংলায় চোখ লাল হয়ে গেলে মাটিও হবে, তামিল কবি ও গীতিকার বৈরামুথু রচিত ‘মনিধা মনিধা ইনি উন ভিজিগাল শিবান্ধল উলাগাম ভিদিয়ুম’ অর্থাৎ ক্রোধে চোখ লাল হয়ে গেলে পৃথিবী জেগে ওঠে। এই গানটি এক সময় জাগরণের গান হিসাবে তামিলনাড়ুতে বামপন্থীদের মন জয় করেছিল। তাদের বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদ সভাগুলিতে গানটি গাওয়া হত, বিশেষ করে মে দিবসের সমাবেশ এবং অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। পরের গানটি রাজাচন্দর পরিচালিত ‘মিস্টার ভারত’, ১৯৮৬; ছবির গান, বৈরামুথুর লেখা ‘এঝুগাভে পদাইগাল এঝুগাভে’ (রাইজ ইয়ে ফোর্স রাইজ)। উল্লেখ্য, দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ধরণের ব্যালাড, লোককাহিনী, নৃত্য এবং নাটকের কেন্দ্রস্থল এবং সেই মাটিতে জন্মানো ইলিয়ারাজা তামিল সিনেমার জন্য সঙ্গীত সৃষ্টিতে লোকজ সুরেই প্রভাবিত হয়েছিলেন। সিনেমা নির্মাতারা তাঁর সঙ্গীতের উপর নির্ভর করেই অনেক গ্রাম-কেন্দ্রিক বিষয় বাছাই করতেন। ১৯৭৬ সালে ‘আন্নাকিলি’, ১৯৭৭ সালে ভারতীরাজা পরিচালিত, কমল হাসান, শ্রীদেবী এবং রজনীকান্ত অভিনীত ‘পাধিনারু ভায়াথিনিলে’ বাংলায় ১৬ বছর বয়সে; ১৯৮০ সালে দেবরাজ-মোহন পরিচালিত ‘রোসাপ্পু রবিক্কাইকারি’ বাংলায় গোলাপি রঙের ব্লাউজ পরা মেয়ে প্রভৃতি। এরপর বছরের পর বছর ধরে নব্য-নৃতত্ত্ববাদী বিষয় নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের একটি সিরিজ যা আমাদের রামরাজন এবং রাজকিরণের মতো নায়কদের উপহার দিয়েছে, এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে ‘গ্রামের নায়ক’ চলচ্চিত্রের কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ইলিয়ারাজার দ্বারা সম্ভব হয়েছিল। গ্রামীণ জীবন-রিল সংযোগের একটি উদাহরণ ১৯৯০ সালে এন কে বিশ্বনাথন পরিচালিত ‘পল্লাক্কু কুথিরাইলি বাভানি ভারুম মীনাচি’ (দেবী মীনাক্ষী একটি পালকিতে বসেছেন)।

সিনেমা সঙ্গীতে ইলিয়ায়ারাজার এরকম অবদান সাধারণ নয়, কারণ তা অনেক কথাই তুলে ধরে। প্রথমত তিনি সঙ্গীতকে সাধারণ ফুটপাথবাসী থেকে উচ্চস্তরের মানুষের কাছে যেভাবে পৌঁছে দিয়েছেন তাতে তাঁর সঙ্গীত জাতি, ধর্ম ও শ্রেণী নির্বিশেষে সকলের কাছে পৌঁছেছে। তাঁর সঙ্গীতের কাজ লোকসঙ্গীতকে যেমন সম্মানিত করেছে তেমনি জনপ্রিয় করেছে, একই সঙ্গে ধ্রুপদী কর্ণাটক সঙ্গীতকেও সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। জানা যায়, কর্ণাটক সঙ্গীতের কনসার্টে উচ্চবর্ণের মধ্যেও খুব কম লোকই উপস্থিত হন, কিন্তু ইলায়ারাজা তার সঙ্গীতের মাধ্যমে এটিকে এমনভাবে সরলীকৃত করেছেন যে সাধারণ মানুষ সঙ্গীতের প্রাথমিক জ্ঞান বা প্রশিক্ষণ ছাড়াই ধ্রুপদী রাগ উপভোগ করতে পারেন। একসময় যখন ইলায়ারাজা মূল রাগ থেকে ভিন্ন রাগে একটি ত্যাগরাজ কৃতি রচনা করেছিলেন, তখন তাঁর অগ্রগামী সঙ্গীতজ্ঞ কৃষ্ণ, যিনি সঙ্গীতের সবকিছু পরিবর্তন করতে চান, তিনি ইলায়ারাজার সমালোচনা করেছিলেন। জা জেনেও বলা যায় পরবর্তীতে কৃষ্ণ নিশ্চয় ইলিয়ারাজা সম্পর্কে তাঁর ধারনা বদলে ফেলেছেন। তবে ১৯৭০-এর দশকে ইলিয়ারাজার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং ১৯৮০-এর দশকের গোড়ার দিকে ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কর্ণাটকী সঙ্গীতের বিশুদ্ধবাদীদের কাছে ভালো লাগেনি এবং বাধা তৈরি হয়েছিল। এমএসএস পান্ডিয়ান ১৯৯০ সালে তার ‘তামিল সিনেমা এবং সাংস্কৃতিক অভিজাত’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানান, সুপরিচিত সঙ্গীত সমালোচক সুব্বুদু, যিনি ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিশুদ্ধবাদী হিসেবে পরিচিত, ইলিয়ারাজার সঙ্গীতের জনপ্রিয়তাকে মাদকাসক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, “ইলিয়ারাজার সঙ্গীত মাথাব্যথা থেকে রেহাই পেতে একটি ট্যাবলেটের মতো ছিল, এর কোনও স্থায়ী মূল্য ছিল না।”

অন্য দিকে, ইলিয়ারাজার বিশাল সাফল্যের কারণে, ধ্রুপদী সঙ্গীতকে দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করে তাকে অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা দেখে ধ্রুপদী সঙ্গীতজ্ঞ সেম্মাঙ্গুদি শ্রীনিবাস আইয়ার বলেন, “ইলিয়ারাজা একজন মেধাবী মানুষ। তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন এবং বিখ্যাত সুরকারদের সঙ্গে সিম্ফনি পরিচালনা করেছিলেন; তাঁরা ইলিয়ারাজার কথা শুনেছিলেন এবং তাঁর প্রশংসা করেছিলেন। তিনি ধ্রুপদী সঙ্গীত ভালই জানেন, এখন তিনি কিছু সহজ সঙ্গীত পরিবেশন করছেন তবে আমার মনে হয় তিনি ধীরে ধীরে উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গীতের মাত্রা বৃদ্ধি করবেন এবং কর্ণাটকী সঙ্গীত সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞানী করে তুলবেন।” পান্ডিয়ান বলেন, এই বিবৃতিটি ইলিয়ারাজার ধ্রুপদী সঙ্গীতের দক্ষতা এবং অভিজাত জগতের অংশ হিসেবে পুনরুদ্ধারের জন্য উভয়কেই উদ্বুদ্ধ করে। তবে বছরের পর বছর ধরে, তাঁর জনপ্রিয়তাকে রোধ করতে না পেরে, সঙ্গীতে ঐতিহ্যগত বিশুদ্ধতাবাদের দুর্গ, সঙ্গীত একাডেমি, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তাদের সঙ্গীত উৎসব উদ্বোধনের জন্য ইলিয়ারাজাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। যদিও এই পদক্ষেপের সমালোচনা করা হয়েছিল, তবুও প্রতিষ্ঠানের অনেকেই এটিকে সমর্থন করেছিলেন। যা কেবল ইলিয়ারাজাকে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে গ্রহণ করাই নয় বরং ‘বিশুদ্ধ ধ্রুপদীদে’র অভিজাত জগতে তাঁর উত্থানের মানচিত্র তৈরি করে দেয়।

(চলবে)