আপামর বাঙালি সিনেমা প্রেমীদের কাছে ২৪ জুলাই দিনটি বিষণ্ণতার প্রতীক।কিন্তু কেন ৩রা সেপ্টেম্বর মহানায়ক উত্তমকুমারের জন্মদিনটি সেভাবে স্মরণ করা হয়না; এর উত্তর পাইনি। নানা মঞ্চে নানা ভাবে তাকে স্মরণ করা হয়। সেই স্মরন কখনও আদিখ্যেতা বলেও মনে হয়, পাশাপাশি আরওএকটিপ্রশ্নও জাগে উত্তমকুমারকেকিএলিট বাঙালি স্বীকৃতি দিয়েছে,বাম বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় কি তিনি সেভাবে জায়গা পেয়েছেন, বরং উত্তম কুমার এখানে অনেকটাই ব্রাত্য।

সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘নায়ক’-এ আসল উত্তমকুমারকে স্টারডমের বাইরে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। নায়ক আর চিড়িয়াখানার পর সত্যজিৎ-উত্তম জুটিকে আর একসঙ্গে দেখা যায়নি। সুচিত্রা সেনকে নিয়ে দেবী চৌধুরানী ভেবেছিলেন, কিন্তু শ্রীমতী সেন রাজি হননি। সুচিত্রা সেনকে নিয়ে ঋত্বিক ঘটকও ছবি করার কথা ভেবেছিলেন। এমনকি উত্তমকুমারকে নিয়েও ঋত্বিক ছবির কথা ভেবেছিলেন। যদিও ঋত্বিকের কিন্তু বহু ছবির কাজ মাঝপথে থেমে গিয়েছিল। বহু ছবির চিত্রনাট্য লেখা শেষ হলেও কাজ শুরু হয় নি। পাশাপাশি এমন বিষয় নিয়ে তিনি ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন যা ভাবাই কঠিন।

ঋত্বিক লিও টলস্টয়ের ‘রেজারেকশন’ নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা ভেবেছিলেন। কেবল ভাবনা নয় ঋত্বিকের রেজারেকশন পরিকল্পনায় সুচিত্রা সেনকে দিয়ে অভিনয় করানোর কথা ভেবেছিলেন তিনি। সে কথা তিনি শ্রীমতি সেনকে জানিয়েওছিলেন। শোনা যায় সুচিত্রা সম্মতি দিয়েছিলেন। তবে ছবিটা শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাতেই থেমে থাকে। এমনও শোনা যায় যে, ঋত্বিক ঘটকের ‘রঙের গোলাম’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু রেজারেকশন ছবিতে কাজ করতে সম্মত হলেও ‘রঙের গোলাম’-এ কাজ করতে সুচিত্রা সেন নাকি আপত্তি করেছিলেন।

তবে উত্তমকুমারকে নিয়ে ঋত্বিক নির্দিষ্টভাবে কোনো ছবির কথা ভেবেছিলেন বলে এখনও কোনও কোনও গল্প শোনা যায় নি। তবে তাঁদের দুজনের মধ্যে যে সখ্যতা ছিল তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়।টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে শুটিংয়ের মধ্যেই মহানায়ক হঠাৎ শুনলেন যে, ঋত্বিক ঘটক অসুস্থ অবস্থায় নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন।এর কিছুদিন পর ঋত্বিক শুরু করবেন ‘তিতাস’-এর শুটিং। মহানায়ক স্যুটিং থামিয়েই ছুটলেন ঋত্বিক ঘটককে দেখতে। তখন দিনের বেলায় কলকাতার নার্সিংহোমে যাওয়াটা মহানায়কের পক্ষে বেশ ঝুঁকির কাজ, তা স্বত্বেও তিনি ছুটে গিয়েছিলেন।

এই ঘটনার আগেও বেশ কয়েকবার উত্তমকুমারের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের দেখা হয়েছে এনটি-ওয়ান স্টুডিওর ক‍্যান্টিনের সামনে। যতবার তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছে প্রত্যেকবারই ঋত্বিক ঘটকের সেই এক কথা, “উত্তম আমি একটা ছবি করছি, তুমি হবে তাঁর হিরো, করবে তো? অত‍্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উত্তমকুমার একটাই জবাব দিতেন, ‘এ কথা তো রোজই বলেন আপনি, যেদিন খুশি শুরু করুন, আপনার জন্য আমার সময়ের অভাব হবে না’। নার্সিংহোমে শুয়েও উত্তমকে দেখে ঋত্বিকের সেই একই কথা। সেরে উঠেই তোমাকে নিয়ে সেই ছবিটা বানাবো। উত্তমকুমার সেই পুরনো কথা শুনে সেদিনও হেসে বলেছিলেন, ‘সে দেখা যাবে, আগে আপনি সেরে উঠুন’

তবে উত্তমকুমার মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলেন যে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিটি তিনি ঋত্বিক ঘটককে দিয়েই করাবেন। উত্তমকুমার সেই প্রস্তাব ঋত্বিক ঘটকের কাছে পেশও করেছিলেন। তাতে ঋত্বিক নারাজ হন নি। আসলে সেই সময় ঋত্বিকের টাকার খুব দরকার ছিল। শোনা যায় উত্তমকুমার এর জন্য ঋত্বিককে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। এরপর ঋত্বিক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, উত্তমকুমার বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেন কিন্তু ঋত্বিক আর সেরে উঠতে পারেন নি।

গৌতম ঘোষের কাছে শোনা গল্প- ১৯৮০ সালে গৌতম'মা ভূমি' তেলুগু ভাষায় ছবির শ্যুটিং করছেন অন্ধ্রপ্রদেশে। ২৪ জুলাই তাঁর জন্মদিন, শ্যুটিং শেষে রাতে কলকাতায় ট্রাংক বুক করেছেন, জন্মদিনে মায়ের সঙ্গে কথা বলবেন বলে, তখনই জানলেন মহানায়কের প্রস্থানের খবর। দুঃখ পেলেন নানা কারণেই। গৌতম সমরেশ বসুর 'শ্রীমতী কাফে' নিয়ে ছবি করবেন ঠিক করেছিলেন। উপন্যাসের স্বত্ব নিয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, সেই ছবিতে উত্তমকুমারকে ভেবেছিলেন গৌতম, উত্তমকুমারের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে রাজিও করিয়েছিলেন। পরে 'শ্রীমতী কাফে' নিয়ে আর ভাবেন নি গৌতম। প্রসঙ্গত, গৌতম ঘোষের আরেক বন্ধু, বাংলা ছবির বলিষ্ঠ অভিনেতা শমিত ভঞ্জ মারা গিয়েছিলেন ২৪ জুলাই ২০০৩ সালে।
Share.

2 Comments

  1. bipul samanta on

    দুজনের কেউই উপযুক্ত সম্মান পাননি, মৃত্যুর পর বাঙালি দুজনকে নিয়েই আদিখ্যেতা করেছে।

Leave A Reply

Exit mobile version